কাশিমবাজারের পাতালেশ্বর মন্দিরের অতীত ও বর্তমানের রূপরেখা

কাশিমবাজারের পাতালেশ্বর মন্দিরের অতীত ও বর্তমানের রূপরেখা

Reported By : Anuradha

মুর্শিদাবাদের অন্যতম প্রাচীন মন্দির হল কাশিমবাজারের পাতালেশ্বর শিব মন্দির। এই পাতালেশ্বর শিব মন্দির বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম জনপ্রিয় স্থান। প্রতিদিন বহু সংখ্যক দর্শনার্থী বাবা পাতালেশ্বরের দর্শনের জন্য এই মন্দিরে আসেন। তবে শ্রাবণ মাসের সোমবার গুলোতে ভীড় যেন এখানে উপচে পড়ে। ব্রিটিশ আমলে এই মন্দিরের আশেপাশের জায়গাগুলি নীল চাষের জন্য ব্যবহৃত হত এবং সেই সময় এই শিব মন্দিরটি ছিল ছোট। তবে বর্তমানে মন্দির চত্বরটি আরও বড় এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, এই মন্দির প্রাঙ্গণটি বড় সুন্দর। সেখানে রয়েছে সাজানো বাগান, গোশালা ইত্যাদি। দর্শনার্থীদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য রয়েছে পানীয় জলের ব্যবস্থা। এছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য পাবলিক টয়লেটেরও সু-বন্দোবস্ত এখানে রয়েছে। তাছাড়া মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কাটিগঙ্গা ও তার পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম।

পাতালেশ্বরের শিব মন্দিরটি মোটামুটি ৩০০ বছরের পুরনো। দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটি প্রায় দুই বিঘা জমির উপর অবস্থিত। মূল মন্দিরের সামনের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে রয়েছে মন্দিরের প্রবেশ পথ। পূর্ব দিকে রয়েছে একটি গণেশ মন্দির এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে মনসা মন্দির। আর মূল মন্দিরের পেছনদিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে রয়েছে কাটিগঙ্গা। এরপর পুরো মন্দির চত্বরটি ঘুরে দেখলে দেখা যাবে পুরো মন্দির চত্বরটি ঘেরা রয়েছে উঁচু প্রাচীর দিয়ে। এবার আমরা মন্দির চত্বরের সীমানার দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব এই মন্দির চত্বরের উত্তর দিকে রয়েছে সতীদাহ ঘাট এবং উত্তর দিক থেকে পূর্ব দিকে বয়ে চলেছে কাটিগঙ্গা। মন্দির চত্বরের পশ্চিম দিকে রয়েছে আনন্দময়ী কালী বাড়ি আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে কৃপাময়ী কালী বাড়ি।

কাশিমবাজারের পাতালেশ্বর মন্দিরের বর্তমান পূজারী হলেন সমীর ঘোষাল। তিনি নদীয়া জেলার লোক। তবে বর্তমানে তিনি কাশিমবাজারেই বসবাস করেন। এই কাশিমবাজার অঞ্চলেই তাঁর শ্বশুরালয়। সমীরবাবুর দুই পুত্র। তার মধ্যে জোষ্ঠ পুত্র মহাদেবের আরাধনার কাজেই নিযুক্ত। সমীরবাবুর কাছ থেকে জানা যায়, প্রথম জীবনে তিনি চাকরি করতেন। পরে মহাদেবের টানে চাকরি ছেড়ে এখানে এসে বর্তমানে তিনি এখন মহাদেবের সেবায় নিযুক্ত। তিনিই বর্তমানে পাতালেশ্বর মন্দিরের একমাত্র পূজারী। শুধু পাতালেশ্বর নয় তার পাশাপাশি অবস্থিত দুটি মন্দির অর্থাৎ গণেশ মন্দির এবং মনসা মন্দিরেও তিনিই পুজো করেন। বিগত প্রায় কুড়ি বছর ধরে অর্থাৎ পাতালেশ্বরের এই শিব মন্দিরটি সংস্কারের পর যখন নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠা হয় সেই সময় থেকেই তিনি এখানে পুজো করেন। জানা যায়, এই পাতালেশ্বরের শিব মন্দিরটি সংস্কারের পূর্বে এখানে কোনো স্থায়ী পুরোহিতমশাই ছিলেন না। তখন প্রত্যেকদিন বিকালে চার থেকে পাঁচ জন মন্দিরের দালানে বসে রামায়ণ পাঠ করতেন। বিকেলের সেই রামায়ণ পাঠ শুনতে সেখানে তখন অনেক মানুষজন যেতেন। কিন্তু মন্দির মন্দিরটি সংস্কারের পূর্বে সেখানে বাবার পুজো দিতে মানুষের সেরকম ভীড় দেখা যেত না। কারণ সংস্কারের পূর্বে মন্দিরের চারপাশে ছিল বহু জঙ্গল এবং সাপখোপের আড্ডাখানা। তাই মানুষজন সেখানে পুজো দিতে যেতে ভয় পেত। ফলে বর্তমানের মতো পাতালেশ্বরের এই শিব মন্দিরে মানুষের ঢল তখন দেখা যেত না।

বর্তমানে কাশিমবাজারের পাতালেশ্বরের শিব মন্দিরে মহাদেবের পুজো হয় সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে বেলা ১ টা পর্যন্ত (তবে ব্যতিক্রম ছিল করোনা নামক অতিমারীর সময়)। কারণ, বর্তমানে পুরোহিতমশাই মন্দিরে আসেন সকাল সাড়ে দশটায়। তবে মন্দিরে প্রবেশের প্রধান ফটকটি খোলা হয় সকাল ১০টাতে। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু সোমবার। সোমবার সকাল ১০ টা থেকে বেলা ১:৩০ মি. পর্যন্ত মন্দিরে প্রবেশের দ্বারটি খোলা থাকে এবং মহাদেবের পূজো হয়।

কারণ সোমবার মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। আবার বিকালে (নিত্যদিন) ৪ টে থেকে রাত্রি সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত থাকে। প্রকৃতপক্ষে, বাবা পাতালেশ্বরের পুজো হয় দিনে তিনবার। সকালে, দুপুরে এবং সন্ধ্যায়। তবে ভক্তরা মন্দির খোলা থাকাকালীন যে যখন মহাদেবের পুজো দিতে আসেন পুরোহিতমশাই পুজো করে দেন।

আর সন্ধ্যাবেলায় প্রতিদিন ধুমধাম করে হয় বাবা পাতালেশ্বরের আরতি। বাবা পাতালেশ্বরের আরতির পর সেখানে পরপর আরও চারটি মন্দিরে আরতি হয় (যথা: গণেশ মন্দির, মনসা মন্দির, কালী মন্দির ও ছোট শিব মন্দির)। আরতি শুরু হয় মোটামুটি সন্ধ্যে ৭:৩০ মিনিট নাগাদ। তারপর উপরে উল্লেখিত সবকটি মন্দির পরিক্রমা করে আরতি সমাপ্ত হতে প্রায় সাড়ে ৮ টা বেজে যায়। আর এই আরতি শেষ হওয়ার পরই বন্ধ করে দেওয়া হয় মন্দিরে প্রবেশের প্রধান ফটকটি। তবে আরতির পর বাবা পাতালেশ্বরের মন্দিরে সারা বছর প্রতি সোমবার সন্ধ্যায় মহাদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় পায়েস ভোগ। এছাড়া পাতালেশ্বর মন্দিরে বাবা পাতালেশ্বরকে নিত্যদিন ফল নিবেদন করা হয়। তবে মহাদেবের বিশেষ পুজোর দিনগুলোতে যেমন ফাল্গুন মাসের শিবরাত্রি, এছাড়া শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবারে বাবা পাতালেশ্বরের উদ্দেশ্যে পুরোহিত মশাই নিবেদন করে থাকেন অন্ন ভোগ। তবে অন্ন ভোগ বলতে মহাদেবকে সাদা ভাতই নিবেদন করা হয়। এবার আসি বাবা পাতালেশ্বরের বিশেষ পুজোর প্রসঙ্গে। জানা যায়, প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের চতুর্দশী তিথিতে হয় বাবা পাতালেশ্বরের সেই বিশেষ পুজো। আর সেই সময় সারাদিন উপোস থেকে রাত্রি তিন প্রহরে ওই বিশেষ পুজো সম্পন্ন করে থাকেন পুরোহিত সমীর ঘোষাল মহাশয়। এছাড়া শ্রাবণ মাসের প্রত্যেকটা দিন পাতালেশ্বরের শিব মন্দিরে মানুষের ভিড় তো লেগেই থাকে; তবে শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবারে মন্দিরে জন সমাগম থাকে দৃষ্টান্তমূলক।

পাতালেশ্বর মন্দিরে প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রির সময় একবার বড়ো করে উৎসব হয়। বহু দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন এই উৎসবে সামিল হতে। যদিও এই উৎসবটি হয় ভক্তদের দানের অর্থের ওপর ভিত্তি করে। এই সময় এখানে দশ দিন ধরে মেলা হয়। ফলে এখানে বহু মানুষের সমাগম ঘটে এই সময়। তাদেরকে প্রসাদ বিতরণেরও ব্যবস্থা থাকে।

প্রায় ৩০- ৪০ হাজারের বেশি মানুষ এই সময় এখানে প্রসাদ পান। প্রসাদ বিতরণ শুরু হয় সকাল ১২ টা থেকে। চলে রাত্রি ১২ টা পর্যন্ত। মন্দির কমিটির সদস্য বিজয় চ্যাটার্জীর কাছ থেকে জানা যায়, বর্তমানে পাতালেশ্বর মন্দিরের সভাপতি হলেন সুহাস বায় এবং সচিব হলেন সুমিত রায় ওরফে মিন্টু। পাতালেশ্বর মন্দির কমিটির সদস্য সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২৫ জন। আরও জানা যায়, এখানে শিবরাত্রির দিন যে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সেই বিশাল অনুষ্ঠানকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য এই সময় আলাদা ভাবে একটি কালচারাল কমিটি ও একটি উৎসবের কমিটি তৈরি করা হয়। তবে এখানকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বলতে মূলত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথাই বলা হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানে মূলত ধর্মীয় নাচ, গান হয়ে থাকে। সেই সময় বাইরে থেকেও অনেক শিল্পী এখানে আসেন। যেমন, এবছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে জি বাংলার সংগীতের শো 'সা রে গা মা পা'-এর চ্যাম্পিয়ন কীর্তনীয়া পদ্মপলাশ হালদার এসেছিলেন এখানে গান গাইতে। পাতালেশ্বর মন্দিরে এই সময় নামে মানুষের ঢল।

জানা যায়, পাতালেশ্বর মন্দিরের সাথে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সরাসরি যুক্ত না থাকলেও এই মন্দিরের উন্নতিকল্পে বহু ধনী ব্যবসায়ী এবং বিশিষ্টজনেরা বহু অর্থ দান করেছেন। এই সূত্রে প্রথমেই বলতে হয়, আগরওয়াল পরিবারের কথা। দীর্ঘদিন থেকে এই মন্দিরের জন্য ক্রমাগত বহু অর্থ দান করে চলেছেন এই আগরওয়াল পরিবারের সদস্যরা। রতনলাল আগরওয়াল ছিলেন এই পাতালেশ্বর মন্দিরের প্রথম সভাপতি। যদিও বর্তমানে তিনি রামকৃষ্ণলোক প্রাপ্ত করেছেন। তবে রতনলাল আগরওয়াল বর্তমান না থাকলেও তার উত্তরসূরীরা এখনও পর্যন্ত মন্দির কমিটির পাশে রয়েছেন এবং মন্দিরের জন্য তারা যথেচ্ছ অর্থ দান করে থাকেন। এছাড়াও জানা যায়, এই পাতালেশ্বর মন্দিরের সাথে কোনো বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সরাসরি যুক্ত নেই। তবে অনেক রাজনীতিবিদই এই মন্দিরে এসেছেন মন্দির পরিদর্শন করতে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সূত্রে বলা দরকার, বহরমপুর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বিরোধী দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বেশ কয়েকবার এই পাতালেশ্বর মন্দিরে আসেন এবং মন্দির কমিটির সদস্যদের সাথে কথাবার্তা বলেন। উল্লেখ্য, বর্তমানে রাজবাড়ির আর কোনো সদস্য সরাসরি এই পাতালেশ্বর মন্দিরের সাথে যুক্ত না থাকলেও তারা মাঝে মধ্যেই এই পাতালেশ্বর মন্দির পরিদর্শনে আসেন। একসময় কাশিমবাজারের রাজা ছিলেন আশুতোষনাথ রায়। তিনি পরলোক গমন করেছেন। তার পুত্র কমলারঞ্জন রায়ও গত গত হয়েছেন। তবে কমলারঞ্জন রায়ের পুত্র প্রশান্ত রায় বর্তমানে রয়েছেন এবং তিনি মাঝে মধ্যেই আসেন এই পাতালেশ্বর মন্দিরে পরিদর্শনের জন্য।

এবার আসি মন্দিরের আয়ের প্রসঙ্গে। পাতালেশ্বর মন্দিরের আয়ের কথা বলতে গেলে বলা যায়, মন্দিরের তেমন কোনো আয় নেই। এই মন্দিরটি চলে মূলত মানুষের দানের উপর ভিত্তি করে।

আর দানের সূত্রে প্রথমেই যাদের কথা বলতে হয় তারা হলেন উপরে উল্লিখিত রতনলাল আগরওয়াল ও তার উত্তরসূরীরা। তারা মন্দিরের উন্নতিকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করে থাকেন। এছাড়া মন্দির কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় যান মন্দিরের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে। ​

এরপর মন্দিরের আয় সূত্রে পাতালেশ্বর মন্দির কমিটিরই এক সদস্য বিজয় চ্যাটার্জী জানান, এবছরও ফাল্গুন মাসে বাবা পাতালেশ্বরের পুজো, মন্দিরের সাজসজ্জা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মানুষকে প্রসাদ বিতরণ বাবদ প্রায় ২২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। আর ভক্তদের দানের অর্থের উপর ভিত্তি করেই তারা এই পরিমাণ বিপুল অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছেন।

এরপর পাতালেশ্বর মন্দিরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে মন্দির কমিটির সদস্য বিজয়বাবু জানান, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হল এই মন্দিরের ভেতর একটি ধ্যানগৃহ তৈরি করার। শুধু এটুকুই নয়, তাদের আরও একটি বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে সেটি হল বৃদ্ধদের জন্য একটি আবাস অর্থাৎ বৃদ্ধাবাস করার। তবে সেটি অনেক ব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় তা বাস্তবায়িত করা তাদের পক্ষে এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ, মন্দিরের পুরো ব্যবস্থাপনাই যেহেতু চলে মানুষের দানের অর্থের উপর ভিত্তি করে।

পাতালেশ্বর মন্দিরের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়ে সুদৃশ্য এক ফুলের বাগান। সেখানে রংবেরঙের নানান ধরনের ফুলের গাছ লাগানো রয়েছে। সেই বাগানটি দেখাশোনা করার জন্য রয়েছে একজন মালী। তিনি শীতকালে বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছের চারা এনে লাগান ওই বাগানে।

এরপর বাগান পেরিয়ে মূল মন্দিরের দিকে কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ে বহু প্রাচীন বট ও অশ্বত্থ গাছ। গাছের গোড়া দুটি বর্তমানে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে মন্দিরের সামনে অবস্থিত এই প্রাচীন বটবৃক্ষ বহন করে চলেছে ইতিহাসের বহু সাক্ষী। মনে করা হয় বট গাছ হল মহাদেবের প্রতীক। তাছাড়া বটগাছের গোড়ায় রাখা রয়েছে মহাদেবের লিঙ্গ, ত্রিশূল ও মহাদেবের বাহন শম্ভু ষাঁড়ের মূর্তি। ফলে ভক্তরা সেই বট গাছের গোড়াকেও পুজো করেন। তারা সেখানে ধূপ দেন, প্রদীপ জ্বালান।

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজার স্টেশন থেকে ২-৩ কিমি দূরে অবস্থিত এই পাতালেশ্বর মন্দিরটি। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, পাতাল শব্দের অর্থ মাটির তলায়। এখানকার শিবলিঙ্গটি যেহেতু পাতাল থেকে মাটি ভেদ করে উঠে এসেছে তাই এখানকার শিবলিঙ্গের নাম দেওয়া হয়েছে পাতালেশ্বর। আর এই শিবলিঙ্গটিকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে পাতালেশ্বর মন্দির।

এখানে প্রায় ৩০০ বছর ধরে ভগবান শিবের আরাধনা হয়ে আসছে। জাগ্রত এই ভগবানের দর্শন পেতে সারাবছরই এখানে ভক্তদের সমাগম হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা তাদের নানা মনোবাঞ্ছা নিয়ে ছুটে আসেন এই মন্দিরে শিবের দর্শনে। আর এই মন্দিরে গর্ভগৃহে প্রবেশের আগে রয়েছে ৬ ফুট লম্বা বারান্দা। গর্ভগৃহের চারপাশেই রয়েছে এমন বারান্দা। এছাড়া গর্ভগৃহের দেওয়ালের বাইরে রয়েছে বিভিন্ন মূর্তি। সেখানে কোথাও রয়েছে হর-পার্বতীর মুর্তি, কোথাও বা অন্য মুর্তি। এইসব মূর্তিরও পুজো করে থাকেন ভক্তরা। ভক্তদের বিশ্বাস, এখানে শিবের কাছে যে যা মানত করে তা পূর্ণ হয়।

মন্দির প্রসঙ্গে বলি, প্রাচীনকালে এই মূল মন্দিরটি ছিল ছোট ছোট ইট দিয়ে তৈরি। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ২০০৬ সাল নাগাদ মন্দিরটি সংস্কারের জন্য তৈরি করা হয় পাতালেশ্বর মন্দির কমিটি। তখন টালির চাল সরিয়ে সেখানে দেওয়া হয় কংক্রিটের ঢালাই, বারান্দাতে বসানো হয় মার্বেল এবং দেওয়ালে লাগানো হয় টাইলস। এই সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয় মোটামুটি ২০০৭ সাল নাগাদ। এরপর মন্দিরটি যখন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় তখন উদ্বোধনের জন্য মন্দির কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেলুড় মঠ থেকে এসেছিলেন স্বামী অচ্যুদানন্দ মহারাজ। উদ্বোধনের পর তিনি এখানে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে মহাদেবের পুজো করেন এবং তারপর বলেন, 'এই শিব স্বয়ম্ভ জ্যোতির্লিঙ্গ'। তবে বর্তমানে যে বাঁধানো সুন্দর মসৃণ শিবলিঙ্গটিকে ভক্তরা পুজো করেন সেটি আসলে প্রকৃতপক্ষে অমসৃণ, এবড়ো-খেবড়ো। এমনকি এই শিবলিঙ্গের মাথার ওপরে বেশ বড় একটি গর্তও আছে। পরবর্তীকালে সংস্কারের সময় এই এবড়ো-খেবড়ো শিবলিঙ্গের ওপরে দেওয়া হয়েছে আবরণ।

এরপর মন্দির কমিটির সদস্য বিজয় চাটার্জী জানান, মন্দির সংস্কারের পরেও কিছু সাধু সন্ন্যাসীদের তিনি এখানে আসতে যেতে দেখেছেন। তারা হঠাৎ হঠাৎ আসতেন, যজ্ঞ করতেন, আবার চলেও যেতেন। তবে তাদের মধ্যে পরবর্তীকালে সত্যনারায়ণ মৌর্য নামে একজন সন্ন্যাসী গঙ্গা দূষণ রোধ করার মানসে সাধু সন্ন্যাসীদের নিয়ে গঙ্গার পাশ দিয়ে গোটা ভারতবর্ষ পরিক্রমা করেছিলেন। বিজয়বাবুর কথা থেকে জানা যায়, সত্যনারায়ণ মৌর্য নামে ওই সন্ন্যাসী মাত্র ঘন্টাখানেকের জন্য পাতালেশ্বর মন্দিরেও এসেছিলেন। এছাড়া বিজয়বাবু আরও জানান, আজ থেকে প্রায় ৭-৮ বছর আগে বৃন্দাবন থেকে ১০০ বছরেরও বেশি বয়সী একজন সাধু এসে এই পাতালেশ্বর মন্দিরে প্রায় একটা গোটা দিন ছিলেন এবং তিনি কাটিগঙ্গার পাশে বসে একটানা সাত দিন যজ্ঞও করেছিলেন। উল্লেখ্য, কিছুদিন পূর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায় যে এখানে বাবা পাতালেশ্বর নিজের এবং সমগ্র মন্দিরের রক্ষা স্বয়ং করে থাকেন। এই ঘটনাটি আশ্চর্য হলেও সত্যি।

আমরা আগেই জেনেছি, এখানকার ভগবান শিব স্বয়ম্ভূ জ্যোতির্লিঙ্গ। সেই সূত্রে আমরা জেনেছি স্বয়ম্ভূ কথার অর্থ। এবার জানব জোতির্লিঙ্গ বিষয়ে। জোতির্লিঙ্গ বলতে হিন্দু দেবতা শিবের বারোটি বিশেষ মন্দির ও সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গকে বোঝায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে এগুলি শিবের পবিত্রতম মন্দির হিসেবে পরিচিত।

পাতালেশ্বর মন্দিরে ঢোকার প্রধান ফটকের উল্টো দিকে রয়েছে শিবের একটি বৃহৎ মূর্তি। এর উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট। আজ থেকে প্রায় ৬-৭ বছর আগে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মন্দিরের ভেতরে রয়েছে একটি দানশালা। যেখানে শিব ভক্তরা দান করে থাকেন।

উল্লেখ্য, 'ক্যালকাটা গেজেট'- এ এক সময় এই পাতালেশ্বর মন্দির নিয়ে বেশ কিছু লেখা বেড়িয়েছিল।

পাতালেশ্বর মন্দিরের পূর্ব দিকে রয়েছে একটি গণেশ মন্দির। গণেশ মন্দিরে স্থাপিত গণেশ ঠাকুরের বিগ্রহটি বহু প্রাচীন। কথিত আছে, এটি রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর বাড়ির পাশের জঙ্গলে পড়েছিল। বহু পরে এই মুর্তিটিকে উদ্ধার করে পাতালেশ্বর মন্দির কমিটি এবং প্রতিষ্ঠা করে বাবা পাতালেশ্বরের মন্দিরের ডান দিকে।

উল্লেখ্য, এই গণেশ মূর্তিটির বিশেষত্ব হল এটি একটিমাত্র পাথরের ওপর কেটে তৈরি করা। জানা যায়, এক সময় রাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর হিন্দুস্থানী রক্ষীরা এই মূর্তিটিকে পুজো করতেন। এরপর এটি পরিভ্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল বহুকাল। তারপর এই বিগ্রহটি উদ্ধার হয়।

আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগে বাবা পাতালেশ্বরের মন্দিরের পূর্ব দিকে গড়ে তোলা হয় গণেশ মন্দিরটি এবং সেখানেই স্থাপন করা হয় গণেশ ঠাকুরের এই বিগ্রহটি। জানা যায়, প্রতিবছর ভাদ্র মাসে বোম্বের গণেশ পুজোর অনুকরণে এখানেও ওই একই সময়ে হয় গণেশ ঠাকুরের বিশেষ পুজো। আর সেই সময় বিপুল পরিমাণ প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

পাতালেশ্বর মন্দিরের বাম দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি মনসা মন্দির। এই মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল পাতালেশ্বরের মন্দিরের ডানদিকে অবস্থিত গণেশ মন্দিরের সমসাময়িক সময়ে। প্রথমদিকে অর্থাৎ ২০০৫ সাল নাগাদ পাতালেশ্বর মন্দিরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত দেবী মনসার মন্দিরটি ছিল ভাঙা অবস্থায়। পরে ২০০৭ সাল নাগাদ এটি সংস্কার করে নতুন ভাবে তৈরি করা হয়। কথিত আছে, বর্তমানে যেখানে দেবী মনসার মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে সেখানে বহু বছর আগে দেখা গিয়েছিল এক পঞ্চমুখী নাগ। তখন এলাকার মানুষজন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সেই পঞ্চমুখী নাগকে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং সেখানেই মাটির তলে পুঁতে দেয়। আর তারপরে দেবী মনসার রোষানাল থেকে মুক্তি পেতে স্থানীয় বাসিন্দারা সেখানে গড়ে তোলে দেবী মনসার মন্দির।

যখন সংস্কারের পূর্বে মন্দিরটি ভাঙা অবস্থায় ছিল তখন মন্দির নির্মাণের এই ইতিহাসটি ওই মন্দিরের গাত্রে খোদাই করা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মন্দিরটি সংস্কারের সময় সেই ইতিহাস ঢেকে দেওয়া হয় টাইলস বসিয়ে। এরপর মন্দিরটি নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করে সেখানে নিত্যদিন পূজার্চনা করা হয়। নিত্যদিন পূজার্চনা করা হলেও বিশেষ পুজো হয় প্রতিবছর আষাঢ় মাসের সংক্রান্তিতে। আষাঢ় মাসের সংক্রান্তি তিথিতে মনসা পূজার এই বিশেষ রীতি এখানে বহুকাল ধরে প্রচলিত রয়েছে।

Leave a Reply