প্রতিভার আত্মহত্যা
"The thought that I might kill myself formed in my mind coolly as a tree or a flower."
Sylvia Plath
ফরাসি দার্শনিক জিন জ্যাকুয়েস রুশোর জন্ম ১৭১২ সালে। মৃত্যু ১৭৭৮। জীবনের শেষ দিকে তিনি প্রচন্ড রকম সন্দেহবাতিক হয়ে উঠে ছিলেন। মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় এই রোগটিকে বলা হয় প্যারানইয়া। সব সময় অদ্ভুত এক ধরনের শঙ্কা নিয়ে তিনি জীবন কাটাতেন। তাঁর ধারণা হয় প্রুশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের রাজা ধর্মযাজক থেকে শুরু করে পৃথিবীর সবাই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।ভয় তাঁকে তাড়া করত সর্বক্ষণ। একবার লন্ডনে গেলেন। সেখানে যেতেই হঠাৎ তাঁর মনে হল, কেউ যেন আড়াল থেকে খুন করার জন্য তাড়া করছে। মনে হতেই হোটেলে মালপত্র রেখে তিনি পালিয়ে গেলেন সমুদ্র উপকূলবর্তী একটি শহরে। ভাবলেন সেখান থেকেই ফ্রান্সে ফিরে যাবেন। কিন্তু এখানেও যেন শক্র। সেখানে গিয়ে দেখলেন সমুদ্রের বাতাস কমে গেছে। এ অবস্থায় জাহাজিরা জাহাজ ছাড়তে চাইল না। তাঁর মনে হল এর পেছনেও কাজ করছে ষড়যন্ত্র। খুন করতে চায়। সবাই তাকে খুব করতে চায়। ফিরে এলেন ফ্রান্সে। অদৃশ্য শত্রু তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। কেউ সযত্নে কফির কাপ এগিয়ে দিলে তাঁর মনে হত কফিতে নিশ্চয় বিষ মেশানো হয়েছে। ঘর থেকে বাইরে বেরোবেন তাতেও ভয়। ভাবেন শত্রুরা ঘরের দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শত্রুদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য তিনি চাইলেন তাঁকে কারাগারে রাখা হোক। কিন্তু কাল্পনিক শত্রুর দরুন তিনি সেখানেও গেলেন না। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ঈশ্বরের সাহায্যপ্রার্থী হলেন। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে একের পর এক চিঠি লিখতে লাগলেন। প্রতিটি চিঠিতে মূর্ত হতে লাগল তাঁর বেদনা হতাশার করুণ আবেদন। চিঠিগুলো পাঠানোর জন্য তিনি কারোর সাহায্য নিতেন না। সবাই তাঁর কাছে অবিশ্বাসী। তাই নিজের চিঠিগুলো দিয়ে আসতেন প্যারির নটরদাম গির্জায়। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এভাবেই সমস্ত চিঠি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যাবে। রুশো একটা দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম বহু দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা আছে।
১৯৬১ সালের জুলাই মাসের এক সকালে নিজের প্রিয় বন্দুকটা মাথায় ঠেকালেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। পরপারে পাড়ি জমালেন কালজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড সি’ সহ বহু গ্ৰন্থের প্রণেতা এবং ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হওয়া এই সাহিত্যিক। পুরষ্কারের ঝুলিতে এই মানুষটির আছে একটি পুলিৎজারও। অরণ্য কিংবা সমুদ্রে শিকার করতে ভীষণ পছন্দ করা এই মানুষটি তাঁর পাখি শিকার করার দোনলা বন্দুকে নিজের খুলি উড়িয়ে দেবেন এমনটা তাঁর ভক্ত শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কল্পনাতেও চিন্তা করেননি। ‘ওল্ড ম্যান এন্ড সি’ নামক কালজয়ী উপন্যাসে এই হেমিংওয়ে বৃদ্ধ সান্তিয়াগোকে দিয়ে বলিয়েছেন,
“Man is not made for defeat . . . [a] man can be destroyed but not defeated”
সেই হেমিংওয়ে কি নিজেই হতাশার কাছে পরাজিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন? জীবনযুদ্ধের রণক্ষেত্রে মাত্র ৬১ বছর বয়সেই ইস্তফা দিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। কিন্তু কেন এই বিদায়? মৃত্যুর খবর চাউর হবার পরপরেই তার স্ত্রী মেরি হেমিংওয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আর্নেস্ট ভোরে শিকারে বের হবার আগে হয়তো তার বন্দুক পরিষ্কার করছিলেন, ভুলক্রমেই হয়তো বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়েছে।"
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তার বাবা ক্লারেন্স হেমিংওয়ে, ভাই লিস্টার হেমিংওয়ে আর বোন উরসালা হেমিংওয়েও আত্মহত্যা করেছেন। হেমিংওয়ে পরিবারের রক্তেই কি মিশে আছে এই আত্মহত্যার বাতিক? নাকি তারা ভুগছিলেন কোনো ব্যাধিতে?
বিশ্বসাহিত্যে শতাধিক খ্যাতনামা কবি-লেখকের খোঁজ মিলবে, যাঁরা আত্মহত্যায় নিজেদের জীবনের ছেদ টেনেছেন। খোঁজ নিলে আরও দেখা যাবে, তাঁদের লেখালেখিতে নিজেদের মনোজগতের ছাপ পড়ুক বা না-ই পড়ুক, তাঁরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিজীবনে প্রবল মানসিক চাপ বয়ে বেরিয়েছেন, যা প্রায়ই তাঁদের এক দুঃসহ বিষণ্নতা ও মনোবৈকল্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ভার্জিনিয়া উলফ্, সিলভিয়া প্লাথ—অতি বিখ্যাত আত্মহননকারী হিসেবে যাঁদের নাম প্রথমেই মনে আসে—প্রত্যেকেই মনোরোগের নানা লক্ষণে আক্রান্ত ছিলেন। হেমিংওয়েকে যত প্রাণপ্রাচুর্যময়ই মনে হোক বা জীবনকে ভোগ করার যত অনুষঙ্গেই নিজেকে তিনি জড়ান না কেন, বাস্তবে জীবনের শেষ দিকে বিষণ্নতা ও মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্তির সঙ্গে তাঁর যোগ হয়েছিল; যাকে বলা যেতে পারে বংশগত বা জেনেটিক আত্মহত্যাপ্রবণতা।
ভার্জিনিয়া উলফের বিষয়ে ধারণা করা হয়, তাঁর শেষ উপন্যাস "বিটুইন দ্য এক্টস"-এর (মৃত্যুর পর প্রকাশিত) পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার পরপরই তাঁকে প্রচণ্ড বিষণ্নতা পেয়ে বসেছিল। তবে সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকবলিত পৃথিবীর নানা দুর্যোগও তাঁর বিষণ্নতাকে মনোবৈকল্যের এক চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। ফলে বিশ শতকের এই মেধাবী লেখক, যাঁর কলমে চেতনাপ্রবাহ রীতি এক অপরূপ দ্যুতিময়তায় মূর্ত হতো, প্যান্টের পকেটভর্তি পাথর নিয়ে সাসেক্সের উস্ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন। স্বামী লিওনার্ড উলফ্কে লেখা সুইসাইড নোটে তিনি তার বিষণ্নতা ও মনোবৈকল্যের নানা লক্ষণের কথা লিখে জানিয়েছেন, তিনি যা করতে যাচ্ছেন তা তাঁর একমাত্র করণীয়।
সিলভিয়া প্লাথের আত্মহননের ঘটনা বহুল আলোচিত রোমহর্ষক। জানা যায়, সিলভিয়া প্লাথ প্রায় সারা জীবনই বিষণ্নতা নিরোধক (অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট) ওষুধ খেতেন। ১৯৬৩ সালে গ্যাস বার্নারে মাথা পেতে নিজেকে অঙ্গারে পরিণত করার অনেক বছর আগে উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
কবি-সাহিত্যিকদের আত্মহত্যার বিশদ তালিকায় সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে তাঁর মৃত্যু কারও কারও জন্য প্রেরণা হয়েও কাজ করেছে। যেমন প্রখ্যাত মার্কিন কবি এ্যানি সেক্সটনের বেলায়। সিলভিয়া প্লাথের আত্মহত্যার খবর পাওয়ামাত্র তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল—"এ তো আমার মৃত্যু। নিজের আত্মহত্যার ঘটনাটি তিনি ঘটিয়েছিলেন কয়েক বছর পর।"
সৃজনশীলতা, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যা—এই তিনের অন্তঃসম্পর্ক নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। মজার ব্যাপার এই, আমাদের আচরণের মূল নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। মনোবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, মানসিক কাঠামোর ওপরেই নির্ভর করে মানসিক রোগ। এক কথায় তাঁরা বলতে চান "disorders of from"। অথচ মানসিক অস্থিরতায় ডুবে থেকেও কী করে যে নিজেকে সৃজনশীলতার শীর্ষে নিয়ে বসাতেন ভ্যান গখ, সে এক বিস্ময়!