" দেহরূপ শিশু শিক্ষা মন্দির " বিদ্যালয়ের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হল। এই বিদ্যালয় স্থাপন প্রসঙ্গে জানা যায়, পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থানার অন্তর্গত বাঁশদা গ্ৰামে জম্মগ্ৰহণ করেন অমল দাস। তাঁর পিতার নাম ননীগোপাল দাস। শৈশব থেকেই অমল দাস অভিনয়, ছবি আঁকা, গান গাওয়া,গলা পরিবর্তন করা ইত্যাদি নানান প্রকার প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি বলেন, ' আমার মতো ধনবান কেউ নেই '। অর্থাৎ প্রতিভাকেই তিনি তাঁর জীবনের অর্থ মনে করেন। সরস্বতী পূজার সময় তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা ধুনুচি নাচ করতেন প্রতিমার সামনে।অমল দাসের বয়স যখন ৪৫ কি ৪৭ বছর তখন তিনি একদিন ভোরে স্বপ্ন দেখেন গ্ৰামে স্কুল গড়ার।নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হত।১৯৯৭ সালে তিনি একটি পুত্র সন্তানের পিতা হন।অমল দাস কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হন। তিনি তাঁর গুরুদেব কে ১৯৯৭ সালে তাঁর স্বপ্নে দেখার কথা বলেন। গুরুদেব তা শুনে বলেন, " তুই মানুষ চাষ কর " । অর্থাৎ প্রকৃত শিক্ষায় শিশুদের শিক্ষিত করে তোল। প্রথমে অমল দাস টিউশনি শুরু করেন।পরে বাবা - মার সহযোগিতায় - অনুপ্রেরণায় স্কুল তৈরির কাজ শুরু করেন। একটি খড়ের চালা ঘরে মাত্র তিন বছরের এক শিশু কে নিয়ে বিদ্যালয় শুরু করেন।এক দিন ছোট্ট শিশুটি মলত্যাগ করলে তিনি শিশুটিকে নিজ হাতে সন্তান স্নেহে শৌচ করে দেন। ওনার এই আন্তরিকতা ও মানবিকতার কথা লোকমুখে প্রচার হয়। ওনার গুরুদেব এই ঘটনার কথা শুনে বলেন, " এভাবে তুমি যদি অন্যের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত কর ,তবে তুমি একজন আদর্শ মানুষ হয়ে সমাজে আদর্শ মানুষ উপহার দেবে। এই ঘটনার পর আস্তে আস্তে বিদ্যালয়ের ছাত্র -ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।২০০১ সালে স্কুল ঘর বড় করতে হয়। যেহেতু বিদ্যালয়টি প্রত্যন্ত গ্ৰামে এবং আদিবাসী ছাত্র -ছাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল সেই কারণেই বিদ্যালয়ের ছাত্র -ছাত্রীদের বেতন বেশি করেন নি।মাত্র ৭০ - ৮০ টাকা বেতন নিয়ে চালাতে থাকলেন বিদ্যালয়টি।২০১৩ সালে ছাত্র -ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫২ জন।তারপর মহামারী কোভিড ও লক ডাউনে বড় ধাক্কা খান অমল দাস। তারপর বিদ্যালয় চালু হল ২০ জন ছাত্র - ছাত্রী কে নিয়ে।অমল দাস ১০ জন ছাত্র -ছাত্রীর জন্য ১ জন শিক্ষক/ শিক্ষিকাদিয়ে পড়াশোনা চালু করেছিলেন। বতর্মানে সেই নিয়মই বলবৎ আছে। আর্থিক সংকটের কারণে তিনি বিদ্যালয়ের গৃহ নির্মাণ করতে পারেন নি। বিদ্যালয়ের ২৫ বছর পদার্পণে একই চিত্র বর্তমান। অমল দাস সর্বশিক্ষা বিভাগে প্রতি বছর ইউ, ডি,আই,এস,ই পূরণ করেন। স্কুলের কোড নং ও আছে। কিন্তু বিদ্যালয়টি কোনো রূপ সরকারি সহায়তা পায় নি। অমল দাস এর স্ত্রী কৃষ্ণা দাস সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নার্স ছিলেন।বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য তিনি স্বামী অমল দাস এর স্বপ্ন পূরণের জন্য এগিয়ে এসে আর্থিক সহযোগিতা করেন।অমল দাস এমন গরীব দরদী সহৃদয় মানুষ ছিলেন, ওনার আর্থিক দুরবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোনো গরীব পরিবারের কেহ তাদের সন্তান - সন্ততিকে পড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে আর্থিক দূরাবস্থার কথা বললে তিনি তা শুনে তৎক্ষণাৎ সেই ছাত্র -ছাত্রী কে সম্পুর্ণ বিনামূল্যে বিদ্যালয়ে ভর্তি ও বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ করে দেন। অমল দাস কে প্রশ্ন করা হয়, বিদ্যালয়ের নাম " দেহরূপ শিশু শিক্ষা মন্দির " নাম করণ কেন? তিনি বলেন, " দেহ হবে রূপবান, যখন হবে শিক্ষাদান তাই তো আমার এরূপ নাম " । একজন মানুষকে রূপবান তখনই বলা যাবে, যখন তার মধ্যে প্রকৃত শিক্ষা থাকবে। থাকবে মানবিক - সামাজিক মূল্যবোধ, থাকবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা,সুস্থ -সামাজ গঠনের প্রচেষ্টা। প্রতিটি ছাত্র -ছাত্রী হোক আদর্শবান ও ভীত হোক মজবুত। নৈতিক চরিত্র হবে অসাধারণ। অমল দাস কে প্রশ্ন করা হয় - বিদ্যালয় চালানোর জন্য কোনো সরকারি সাহায্য পান না, ছাত্র -ছাত্রীদের অধিকাংশকেই বিনামূল্যে পাঠদান করছেন, এই অবস্থায় শিক্ষক/ শিক্ষিকা (১০:১) দশ জন ছাত্র -ছাত্রীর জন্য একজন শিক্ষক/ শিক্ষিকা আছে, আছে অশিক্ষক কর্মচারী তাদের মাসিক সাম্মানিক দিয়ে আপনার তো কিছুই থাকে না। তাহলে আপনার চলবে কি করে? তিনি বলেন, " আমার অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু বেঁচে থাকার জন্য যতটা প্রয়োজন তাতেই চলবে।আর সেটা আমি পারিবারিক ভাবেই পেয়ে থাকি। মৃত্যুর পর ঈশ্বরকে বলতে পারবো যে, আমি অন্যের কথা ভেবেই কর্ম করে গেলাম সারাজীবন। বিচার করার ভার তোমার "। বিদ্যালয়ের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডেবরা ব্লকের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠান ডালিতে ছিল যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতা,গান, আবৃত্তি, নৃত্য, আলোচনা চক্র। সুমিত চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক - শিক্ষিকাদের পড়াশোনার পদ্ধতি, আন্তরিকতা - মানসিকতা,অশিক্ষক কর্মচারীদের সহযোগিতা, মানসিকতা, ভালোবাসা এবং ছাত্র -ছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের মানসিক - সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া, পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া ও ছাত্র -ছাত্রীদের নানান বিষয়ে পারদর্শী করে গড়ে তোলার জন্য উপস্থিত অভিভাবক - অভিভাবিকাবৃন্দ উপস্থিত গ্ৰামবাসীবৃন্দ বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সদস্য - সদস্যা, ও শিক্ষক - শিক্ষিকা,অশিক্ষক কর্মচারীদের উচ্চ প্রসংসা করেন।