ছোটগল্প-রুমির রসিকতা @হীরক মুখোপাধ্যায় স্বত্ব:লেখক
ডিভানে বসা বিধুর দিকে এক কাপ লিকার চা এগিয়ে দিতে দিতে তনুশ্রী জানতে চাইল, ” অনেকের কাছ থেকেই অভিযোগ পাচ্ছি যে তুমি এখন আর আগের মতো রুমির সাথে মেলামেশা করছ না, ওকে ফোন করা তো ছেড়েই দিয়েছ, এমনকি তুমি নাকি ওকে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতেও ব্লক করে রেখেছ, ব্যাপারটা কী একটু খুলে বল তো ?”
তনুশ্রী-র ফ্ল্যাটে আজ প্রথম এসেছে বিধু, কোথায় তনুশ্রী ওর নিজের কথা বলবে তা না; যে বিষয়টা নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতেই ওর ভালো লাগে না, সেই বিষয়ে অযাচিতভাবে তনুশ্রী জানতে চাওয়ায় বিধু বেশ কিছুটা বিরক্ত হলেও বিষয়টা এড়াতে মুখ তুলে উদ্ধতভাবে বলল, “তো !”
তনুশ্রী উপরে গম্ভীরভাবে থাকলেও মনের দিক থেকে খুবই নরম মনের মেয়ে। তার উপর রুমির সাথে ওর মধুর সম্পর্ক। বিধু চাইছিল না তনুশ্রী এই বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে অযথা কষ্ট পায়, তাই বিষয়টা থেকে বেরিয়ে আসতেই ও ইচ্ছে করেই তনুশ্রীর সাথে একটু রাফ ব্যবহার করল।
বিধুর অস্বাভাবিক রূঢ় ব্যবহারে তনুশ্রী প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেলেও, পরক্ষণে নিজের বয়সজনিত উপলব্ধির উপর বিশ্বাস রেখে বিধুর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলল, “অ্যাই, আমার চোখের দিকে তাকাও।”
বিধু তনুশ্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, “চা টা এমন কিছু ভালো বানাওনি যে চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশংসা করতে হবে।”
বিধুর কথা শুনে তনুশ্রী ভেতর ভেতর চটে উঠলেও গলায় মিষ্টি স্বর ফুটিয়ে বলল, “উফ্ ! আমাকে প্রশংসা করতে বলছি না। শুধু বলছি তাকাও আমার দিকে।”
হাত থেকে লা পাওলোর চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বিরক্তি সহকারে বিধু তনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, “নাও দ্যাখো, কী দেখবে দ্যাখো।”
তনুশ্রীর দিকে বিধু তাকাতেই বিধু দেখতে পেল, তনুশ্রী উপর আর নীচের দাঁতের পাটির মাঝে ওর নীচের ঠোঁটটা হালকা কামড়ে ধরে চোখ নাঁচাতে নাঁচাতে যেন জানতে চাইছে ‘বলো বলো…’।
তনুশ্রীর ওই আচরণ দেখে বিধু ফিক করে হেসে ফেলে বলল, “বলছিরে বাবা বলছি। কিন্তু তার আগে আমার একটা কথা আছে, তুমি যদি দিনের বেশিরভাগ সময়টা তোমার অফিস কলিগ আর তোমার বরের সাথে এভাবে হালকা মেজাজে থাকো, তাহলে তো আর অযথা হার্টের ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না !”
“ওসব পরে শুনবো, আগে রুমির আর তোমার ব্যাপারটা খোলসা করে বলো তো।”
“আরে এমন কিছু না, কয়েক মাস আগের কথা…,” বলতে বলতে থেমে গেল বিধু।
“আহা, চুপ করে গেলে কেনো বলো…,” তাগাদা লাগায় তনুশ্রী।
তনুশ্রীর আগ্রহে বিধু বলতে শুরু করে, “এই বছর ভালোভাবে গরম পড়ার আগে এক ছুটির দিন আমি ওর বাড়িতে গেছিলাম। ওর বেটার হাফ সেদিন যেন বনগাঁ বা বসিরহাট গিয়েছিল, তাই সেসময় ও একাই বাড়িতে ছিল।
মিনিট পাঁচেক গল্প করার পর ও আমাকে বলল, ‘তুমি এই বইগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগো, আমি ততক্ষণে তোমার জন্য মধু দিয়ে একটু চা করে আনছি…’।”
“হ্যাঁ গো। তুলসী পাতা, আদা, গোলমরিচ, এলাচ, আর মধু দিয়ে রুমি খুব সুন্দর চা করে। আমাকেও অনেকবার করে খাইয়েছে। খুব সুন্দর লাগে খেতে। তোমাকেও খাইয়েছে তাহলে !”
“খাওয়াতে চেয়েছিল।”
“তুমি খাওনি ?” অবাক হয়ে জানতে চায় তনুশ্রী।
“ওর ওই প্রস্তাব শুনে আমি ওকে বলেছিলাম, ‘কি বলছ তুমি ! মৌমাছি মুখ দিয়ে যেটা বার করে, তুমি সেটা অন্য কিছুর সাথে গুলে আমাকে খাওয়াতে চাইছ ?’
জানো এর উত্তরে ও আমাকে কী বলেছিল ?”
তনুশ্রী ভীষণভাবে অবাক হয়ে চোখ ড্যাবড্যাব করে জানতে চাইল, “কী বলেছিল তোমাকে ?”
বিধু তনুশ্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে গলায় কৃত্রিম রাগ এনে বলল, “ও এত ছোটোলোক সেটা আগে জানলে আমি ওর সাথে আলাপই করতাম না। ও ..”
বিধুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তনুশ্রী বলে উঠল, “যাহ্ ওভাবে বোলো না, ওভাবে বলতে নেই।”
তনুশ্রীর কথায় খেপে গিয়ে বিধু আরো উঁচু গলায় বলে উঠল, “না ওকে পুজো করব…।”
“আরে রুমি তোমাকে কী বলেছিল সেটা তো বলবে ?” গলায় কপট রাগ দেখিয়ে জানতে চাইল তনুশ্রী।
“কী আর বলবে, বলেছিল, ‘এ মা তুমি মধু দিয়ে বানানো চা খাবে না ! তাহলে একটু বোসো, আমি তোমার জন্য গরম গরম ডাবল ডিমের অমলেট করে আনছি’।”
“তুমি অমলেট খেয়েছিলে ?”
প্রশ্নটা করেই বিধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে সোফার অন্য প্রান্তে লুটিয়ে পড়ল তনুশ্রী।