‘জেলার বুকে অতিথি চরণ’ – G Tv { Go Fast Go Together)
‘জেলার বুকে অতিথি চরণ’

‘জেলার বুকে অতিথি চরণ’

REPORTED BY:- তুষার কান্তি খাঁ

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র এর ভাষায়—বাঙালি ইতিহাস অসচেতন জাতি। কিন্তু কোন জাতিই ইতিহাস থেকে মুক্ত নয়। সুতরাং আমাদের ইতিহাস সচেতন হতেই হয়। আবার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ই. এইচ. কার এর মতে—ইতিহাস হল অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে অসমাপ্ত কথোপকথন। প্রত্যেক জাতির একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে। ইতিহাস কখনো উজ্জ্বল, কখনো ম্লান।

উল্লেখ্য, যে কাহিনী বা ঘটনা তা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক যে বিষয়েই হোক না কেন, যদি গতানুগতিক সাধারণ ঘটনা থেকে স্বতন্ত্র হয়, তাহলে তা ইতিহাস এর আওতায় পড়ে। জেনে রাখা দরকার ঐতিহাসিকের জানার কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্য যে প্রয়োজন হয় সেগুলো ইতিহাসের তথ্য। যেকোনো লেখক বা সংকলকের অভিপ্সা হল সামগ্রিক ইতিহাস কে তুলে ধরা।

‘জেলার বুকে অতিথি- চরণ'(প্রথম খন্ড) বইটিতে লেখক গৌতম সরকার মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন মনীষার সম্পর্ক গুলি তুলে ধরেছেন ইতিহাসের আলোকে। বইটিতে দেখানো হয়েছে বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর আগমন ঘটেছে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী হীরা চাঁদ দুগার জিয়াগঞ্জের বাড়িতে। ‘দেশবন্ধু স্মৃতি তহবিলে’অর্থ সংগ্রহের জন্য মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের আহবানে ১৯২৫ সালের ৫ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধী এ জেলায় পা রাখেন। আবার বিশিষ্ট নট, নাট্যকার ও অভিনেতা উৎপল দত্ত ১৯৩৭ সাল নাগাদ ছোটভাই নলিনী কে সঙ্গে নিয়ে জেল কোয়ার্টার থেকে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল যেতেন। তাইতো উৎপল দত্তের কাছে বহরমপুর ছিল আবেগ, ভালোবাসা ও বাল্যস্মৃতির আধার স্থল।

‘মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণা রঞ্জন রায়’প্রবন্ধটিতে দক্ষিণারঞ্জন এর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তথা স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে কর্মকুশলতার বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে। তবে প্রবন্ধ টির নাম ‘মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণা রঞ্জন রায় ‘এর পরিবর্তে দক্ষিণা রঞ্জন মুখোপাধ্যায় হওয়া উচিত ছিল। তাই লেখক এক্ষেত্রে ইতিহাস অসচেতনতার প্রমাণ রেখেছেন। ১৯২৮ সালে সাহিত্যিক বনফুল আজিমগঞ্জ হাসপাতাল এসেছিলেন চিকিৎসক হিসেবে এবং ডাক্তার হিসেবে তিনি পালন করেছিলেন তাঁর সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। একাত্মতায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন এই অঞ্চলের মানুষকে। কিংবা বইটিতে পাওয়া যাবে কবি কালিদাস রায়ের কবি থেকে কবিশেখর হয়ে ওঠার সোপান তৈরি হয়েছিল বহরমপুরে। জাতীয়তাবাদী ইংরেজি ‘ডন ম্যাগাজিন’ও’ ডন সোসাইটির’প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন বহরমপুর কলেজের অধ্যাপক ও কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক। নাট্যকার, অভিনেতা, নাট্যপরিচালক সহ বহু গুণের অধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কে একাধিকবার পান এ জেলার মানুষ। ভারতের রাষ্ট্রপতি তথা শিক্ষাবিদ ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের আগমন ঘটেছিল ১৯৬০ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত আগ্নেয়গিরি কৃষ্ণনাথ কলেজের পুণ্যভূমিতে। তবে ‘মুর্শিদাবাদ এবং সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ’নিবন্ধে রাধাকৃষ্ণানের জেলাশাসকের বাংলোতে রাত্রি বাস, তাঁর প্রিয় ছাত্র বিশ্বেন্দু বাগচীর বাড়ি যাওয়া এবং কাশিমবাজার রাজবাড়ি প্রদর্শনের ঘটনাগুলি লেখক সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন।

এছাড়াও আছে জ্ঞানতাপস দিগম্বর মিত্র ১১ বছর মুর্শিদাবাদ অবস্থানকালে তাঁর আধুনিকতা ও মুক্তচিন্তার ঝর্ণাধারায় সিক্ত হয়েছিলেন রাজা কৃষ্ণনাথ। মনীষী রামমোহনের মনীষী হয়ে ওঠার পেছনে মুর্শিদাবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলা আছে সে কথা ও। ‘মনীশ ঘটক বর্তিকা এবং মহাশ্বেতা ‘এই ত্রিকোণ সম্পর্ক জেলার মানুষের ভোলার কথা নয়। এছাড়াও উঠে এসেছে মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসী প্রীতি, ২০০০ সালের বন্যায় মেডিকেল টিম পাঠানোর কথা। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের শিক্ষক গণিত আচার্য কেশবের সৌরভে আমোদিত হয় এই জেলা।

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের অনুরোধে কান্দি তে মহকুমা করা হয় এবং কান্দির উন্নয়নে তাঁর বিশেষ কীর্তি রয়েছে। বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন এর পক্ষে ভারত সরকারের কাছে প্রেরিত গণ আবেদনপত্রে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রথম স্বাক্ষর করেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। রেভারেন্ড লালবিহারী দে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কে. এন . কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। শ্রী চৈতন্যদেব মালদা যাওয়ার পথে মুর্শিদাবাদের পা রাখেন। অধ্যাপক ও কবি শঙ্খ ঘোষ বাংলার অধ্যাপক হিসাবে কর্মজীবনের সূত্রপাত করেন ১৯৫৫ এর নভেম্বর মাসে জঙ্গিপুর কলেজে। বহরমপুরে ই অবস্থান কালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিনগুলি রাতগুলি’প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজে প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল গণ বিজ্ঞান মেলা। বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯৬৪ সালে কে. এন. কলেজে আসেন এবং বিজ্ঞান বিভাগের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

সাহিত্যিক ও প্রশাসক অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯১৯ এর ২৯শে অক্টোবর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত হন এই জেলার বহরমপুরে। ‘সত্যাসত্য’উপন্যাসের প্রথম খন্ডের সোপান রচিত হয় ১৯৩০-৩২ সালে বহরমপুরে। অন্নদাশঙ্করের মার্কিন প্রণয়ী ও তখন হবু জীবন সঙ্গিনী এলিস ভার্জিনিয়া অর্ণ ডফ কে অন্ধকারে বহরমপুর কোট স্টেশন আনতে যাওয়ার ঘটনাও উল্লেখিত হয়েছে। সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ১৯৯৩ সালে তিনি লিখেছেন—‘রেলস্টেশনের থেকে চলেছি বাড়িতে/সেইদিন মনে মনে চেয়েছি তোমারে।’সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ ইনকাম ট্যাক্স অফিস এ তাঁর জীবিকার কাজে বহরমপুরে বারবার এসেছেন এবং যেখানে সাহিত্য সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন কৃত্তিকা রঞ্জন সিংহ সহ আরো অনেককে।

তথ্য রাজি সংগ্রহ করে সেগুলিকে সুচারুরূপে ব্যবহার ও বিচার বিশ্লেষণ করলে কবে রচিত হয় ইতিহাস। এই কাজটি যারা করেন তাঁরা ঐতিহাসিক, বিশেষজ্ঞ প্রভৃতি নামে পরিচিত হন। প্রসঙ্গত বলা যায় যারা কেবল সন তারিখ মিলিয়ে বংশ বৃত্তান্ত লেখেন অথবা দলিল-দস্তাবেজ এর সারসংক্ষেপ করে বিবরণ মাত্র লেখেন, যাদের ইতিহাস চিন্তা বলে কিছু নেই তাদের ওই বিশেষণে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই গৌতম বাবুর বইটি ইতিহাস অভিধার যোগ্য কিনা, তা ইতিহাস সচেতন পাঠকবর্গের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে তথ্য রাজি সমৃদ্ধ বইটি ইতিহাস চর্চা কারীদের কাছে এক অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

Translate »
Call Now Button