১)
মা বাবার অনেক সাধাসাধিতে পামেলা রাজি হয়েছে সাইকোলজিস্ট এর কাছে আসতে। তাও শর্ত ছিল একটাই সে একা আসবে।উইকএন্ড এর বিকেলে তাই ডিস্কোতে না গিয়ে এখন বসে আছে শহরের বেস্ট মোটিভেশনাল কাউন্সেলর দীপ্তি সেনের চেম্বারে।রিসেপশন এ রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত সব ফর্মালিটি সেরে অপেক্ষা করছে ওয়েটিং এরিয়াতে।কী সুন্দর উজ্জ্বল অথচ শান্ত এই জায়গাটা।এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না।পামেলা ফটোগ্যালারি খুলে পুরোনো ফটো দেখছিল সময় কাটানোর জন্য।অনুষ্ঠানের ছবি ,নাচের পোশাকে বিভিন্ন মুহূর্ত।খুব কম বয়স থেকেই ইন্ডিয়ান কনটেম্পোরারি আর ব্যালেতে ভীষণ পারদর্শী ও।
রিসেপসনিস্ট নাম ধরে ডাকছেন।পামেলা ধির পায়ে এগিয়ে গেল দেখিয়ে দেওয়া দরজার দিকে।সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপারের চেয়ারটা খালি দেখে পামেলা ঘরের অন্য প্রান্তে সোফায় বসলো।ম্যাডাম হয়তো ওয়াশরুমে গেছেন ,এসে পড়বেন।হঠাৎ পাশের সিটে চোখ পড়তে রীতিমত চমকে উঠলো সে।কোনো মানুষের গায়ের রঙ এত কালো হতে পারে এ তার কল্পনার অতীত। এত কালো যে ঘরের নীলচে হালকা আলোয় হঠাৎ করে চেনা দায়।
নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিল।
কালো মুখে ফসফরাসের আলো জ্বলা হাসি নিয়ে তাকালেন
-“হ্যালো!আমি দীপ্তি।তুমি?”
-“পামেলা।পামেলা আগরওয়াল।”
পামেলা মনে মনে একটু হেসেই নিল।এমন কুচকুচে কালো একজন মহিলার নাম দীপ্তি!আর এই দীপ্ত চেহারা নিয়ে ইনি এত মানুষের মন জয় করে ফেলেছেন!
–“কী সমস্যা তোমার বলো এবার।দেখা যাক আমরা দুজনে মিলে সেই সমস্যাকে তুড়ি মেরে ভাগাতে পারি কিনা।”
-“অ্যাজ ইফ আমার কোনো সমস্যা নেই।মা বাবা জোর করছিলেন আপনার কাছে নিয়ে আসবার জন্য তাই বাধ্য হয়ে এসেছি।”
-“গুড গার্ল।আজ বরং আমরা একটু গল্প করি তাহলে। ফিজ এর টাকাটা নিতে নয়তো খুব খারাপ লাগবে আমার।আচ্ছা পামেলা তোমার এমন কোনো খারাপ লাগা আছে ,এমন কোনো স্মৃতি যা তুমি কখনও কাউকে বলতে পারোনি অথচ মনে পড়লেই খুব কষ্ট পাও।সব কিছু তছনছ করে দিতে মন চায়?প্রায় সবারই কিন্তু এরকম কিছু কিছু অভিজ্ঞতা থাকে।”
পামেলা বসে বসে নখ খুঁটছে।ওর চোখে মুখে একটা শক্ত ভাব ফুটে উঠছে।কাঁধে হাত দিয়ে দীপ্তি বললেন
-“মেক ইট ইজি মাই বেবি।আমি তোমার গল্প শুনবো বলেই বসে আছি।ডোন্ট ওয়ারি আমিও তোমায় আমার গল্প বলবো।দেখবে কেমন হালকা লাগে তখন!”
আরও অনেকগুলো কথা তিনি বলে গেলেন।মহিলার গলার আওয়াজে কী জাদু ছিল কে জানে পামেলার হঠাৎই খুব কান্না পেল।ঘরে ঢুকেই যে অস্বস্তি শুরু হয়েছিল সেটা কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।মনে হচ্ছে এই তো একজন যাকে বলা যায় সবটা।
কেমন এক ঘোরের মত পামেলা বলতে শুরু করলো
–
“আমিই আমার একমাত্র খারাপ লাগা।আমার এই ফিজিকটাই আমার সব কষ্টের কারন।আমাদের ফ্যামিলিতে সবাই বেশ লম্বা।শুধুমাত্র আমিই…
ডক্টর বলেছিলেন প্রেগনেন্সিতে মা অসুস্থ থাকায় আমার গ্রোথ ঠিকমতো হয়নি।এটা তো আমার দোষ নয় বলুন!”
ছলছল চোখে তাকায় পামেলা।
দীপ্তি ওর হাতটা পামেলার হাতের উপর রাখলেন ,ভরসার মত।
-“সবাই আমাকে খুব হিউমিলিয়েট করতো।আমার বাড়ির লোকরাও, এমনকি পাপাও বলতো “এ আমার মেয়ে হতেই পারেনা।আমার সন্তানের হাইট কী করে এত কম হয়?”
ইনডিরেক্টলি আমার জন্মকেই অস্বীকার করতেন তিনি।”
এরপর পামেলা দীর্ঘ বক্তব্যে যা যা বললো তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়-
ছোটবেলা থেকেই পামেলা পড়াশোনা এবং নাচে খুবই ব্রিলিয়ান্ট।দেখতেও বেশ সুশ্রী।স্কুল ,কলেজের সমস্ত কম্পিটিশনেই ওর প্রাইজ পাওয়া ছিল একটা স্বাভাবিক নিয়মের মতো।একটু বড় হওয়ার পর অনেকেরই যেমন ফিউচার প্ল্যানিং থাকে তেমনই পামেলারও ইচ্ছে ছিল মডেল হওয়ার কিন্তু ওর হাইট কম হওয়ায় কোনো জায়গা থেকেই ভালো ফিডব্যাক পায়নি।এই সময়েই একজন গ্রুমারের সাথে পামেলার যোগাযোগ হয় যিনি অ্যাসিওর করেছিলেন চান্স পাইয়ে দেবেন বলে।কিন্তু একটা দুটো কাজে খুবই ছোট এপিয়ারেন্স বাদ দিলে আর সেরকম কোনো সুযোগ ঘটেনি।ততদিনে সেই গ্রুমারের সাথে একটা রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছে পামেলা।পরে কাজের জন্য বারবার তাকে নক করলে সেও একদিন সবার মতোই বেঁটের তকমা দিয়ে যাচ্ছেতাই অপমান করে ব্রেকআপ করে চলে গেছে।একদিকে স্বপ্নের মৃত্যু অন্যদিকে প্রেমিকের ছেড়ে যাওয়া এই ডবল ধাক্কা পামেলা সামলে উঠতে পারেনি।ধীরে ধীরে ড্রাগ অডিক্টেড হয়ে পড়ে।ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে শেষপর্যন্ত সুইসাইড করবার চেষ্টাও করে।হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে দিন পনেরো আগে।
তারপর থেকেই মা বাবা বারবার জোর করছিলেন কাউন্সেলিং করানোর জন্য।
-“শোনো পামেলা, তুমি যখন তোমার সমস্যাটা আইডেন্টিফাই করে ফেলেছো তার মানে ইউ আর জাস্ট ওয়ান স্টেপ আওয়ে ফ্রম সাকসেস।এখন সমস্যাটা কী করে সলভ করবে সেটাই হচ্ছে আসল কাজ।ব্যস হয়ে গেল।”
-“হোয়াট আর ইউ টেলিং ম্যাম!এই প্রবলেম সলভ করবো কী করে? কারুর হাইট কি আর বাড়ানো যায়!”
-“নাহ।তা একদমই যায়না।আমরা যে যার ফিজিক নিয়েই জন্মেছি।সেটা তো কিছুতেই পাল্টানো সম্ভব নয়।কিন্তু যেটা করতে পারি,আমাদের মেন্টাল সেট আপ আমরা পাল্টে ফেলতে পারি।তখন দেখবে সব কিছু ইজি হয়ে গেছে।তোমায় একজনের গল্প বলি শোনো।একদম রিয়েল লাইফ স্টোরি।
২)
সেন বাড়ির বড় বউমা সন্তানসম্ভবা এ কি কম আনন্দের কথা।এই প্রজন্মের প্রথম বংশধর আসছে।শুধু সেন বাড়িতেই নয় ,সমস্ত আত্মীয় স্বজনরাও খুব আনন্দিত।হবু মায়ের আদর যত্নের যেন কোনো কমতি না হয় সেদিকে সবার তীক্ষ্ণ নজর।
যা কিছু যত্ন সবই আসলে যে আসছে তার জন্য।সবাই কেন জানিনা ভেবেই নিয়েছে সরমার ছেলেই হবে।গুরুদেব নাকি তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন।কিন্তু হাসপাতালে সেদিন অসহ্য যন্ত্রণার শেষে সরমার মেয়ে হবার খবরে সবাই ভীষন হতাশ হয়।মা বাবা ছাড়া কেউ একবার দেখতেও আসেনি।তিনদিন পরে যখন মেয়ে কোলে হাসপাতাল থেকে সে বাড়ি ফিরেছিল সবার তখন আঁতকে ওঠার মত অবস্থা।একেই মেয়ে তার উপর গায়ের রঙ যেন একেবারে কয়লার খনি থেকে তুলে আনা।বাড়ির কেউ বাচ্চাটাকে কোলে নেয়নি, এমনকি ওর স্বামীও।কোনো আচার অনুষ্ঠান পর্যন্ত বাড়ি থেকে করা হয়নি।সরমা যেদিন আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন “দীপ্তি” ,সবার ঠোঁটেই বিদ্রুপের হাসি তার নজর এড়ায়নি।শাশুড়ি বলেছিলেন এসব আদিখ্যেতা ছেড়ে দ্বিতীয় বাচ্চার কথা ভাবতে।বংশের প্রদীপ চান তারা।পরের বছরই বংশের প্রদীপ এসেছিল।তাকে নিয়ে সবার এত আদর ,এত আহ্লাদ যে সেই সবের আড়ালে দীপ্তি কখন কী করে বড় হল তার খোঁজ একমাত্র সরমা ছাড়া আর কেউ রাখেনি।
তবে দীপ্তির এই বড় হওয়াটা এতটাও নিষ্কণ্টক ছিলনা।উঠতে বসতে কি বাড়ির লোক ,কি আত্মীয় স্বজন ওর গায়ের রঙ নিয়ে এত হাসিতামাশা করতো সেটা একরকম সহ্য হয়েই গিয়েছিল।কিন্তু স্কুলে যখন সবাই এই নিয়ে টন্ট করতো তখন খুব মন খারাপ হতো।মাঝে মাঝেই বাড়ি ফিরে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতো একরত্তি মেয়েটা।টিনএজে সব মেয়েই যখন স্বপ্ন দেখে রাজপুত্তুরের,প্রেমের ,আলো ঝলমল বিয়ের তখন ওকে নিয়ে ছেলেরা প্রকাশ্যে হাসাহাসি করতো।বন্ধুরা বলতো ” ওকে আবার কে বিয়ে করবে!ফুলশয্যার রাতে আলো বন্ধ করলে তো বর অন্ধকারে খুঁজেও পাবেনা”!
এই এত অপমানের মাঝে দীপ্তি শুধু ওর পড়াশোনাকেই আঁকড়ে ধরেছিল।স্কুলে ফার্স্ট হতো বরাবর।মাধ্যমিক ,উচ্চমাধ্যমিকেও স্ট্যান্ড করেছে।আর ছিল আঁকা।খুব ভালো পোর্ট্রেট আঁকত মেয়েটা।সেই দীপ্তি উচ্চমাধ্যমিকে এত ভালো রেজাল্ট করার পরেও ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং এর আশা ছেড়ে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয় আর্টস নিয়ে।ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার এত খরচ বাবা একদমই দেবেননা।তিনি বলেই দিয়েছেন একটা কালো মেয়ের বিয়ে দিতেই যা খরচ তাতে এই ফালতু খরচ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।অগত্যা নিজের মেধা আর কপাল জোরে যা হয়।
এত নামি একটা কলেজে এসেও গায়ের রঙ নিয়ে কম হিউমিলিয়েশন হয়নি।ওর কোনো বন্ধু ছিলনা।এমনকি ওর পাশে কেউ বসতে পর্যন্ত চাইতো না।সেই দীপ্তির জীবনেও একদিন প্রেম এলো।
এমন অনাকাঙ্খিত একটি বিষয় যে ওর জীবনে ঘটতে পারে তা সে কল্পনাও করেনি।ছেলেটি ওদেরই ডিপার্টমেন্টে পড়ে, কিংশুক।সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হবার পর থেকেই লক্ষ্য করতো কিংশুক ক্লাসে ওর পাশে এসেই বসে তা সে অন্য বেঞ্চে বসবার জায়গা থাকলেও।ওর সাথে কারনে অকারনে কথা বলে।লাইব্রেরি গিয়ে একটু পড়বে কি কিংশুক সেখানেও হাজির।দীপ্তি বুঝতে পারতো না এ ছেলে কী চায় ওর কাছে।ওর মধ্যে তো এমন কোনো আকর্ষণ নেই যার জন্য কোনো ছেলে এভাবে পিছু পিছু ঘুরবে।
মা বলেন সবার জীবনেই একদিন ভালো সময় আসে।শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।এতদিনে কিংশুকের হাত ধরে দীপ্তির জীবনের সেই ভালো সময় এসেছে।ওদের মাখো মাখো প্রেমের কথা কলেজের সবাই কমবেশি জানে।অনেকে এই নিয়ে কিংশুককে খোঁচাও দিয়েছে।ও সেসব গায়ে মাখেনি।
গত সপ্তাহে ওদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে।মা জানতে চাইছিলেন এরপর দীপ্তি কী করবে।পিএইচডি জন্য চেষ্টা করবে নাকি আগে বিয়েটা করে নেবে।মা চাইছেন বিয়েটা হয়ে যাক।তারপর অন্য যা কিছু।নাহ,এবার কিংশুকের সাথে কথা বলতেই হবে।ওর মাথায় কী চলছে। নম্বর ডায়াল করলো।ফোনটা রিং হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ও রিসিভ করছে না।পরীক্ষার পর থেকে একবারও কথা হয়নি ওদের।কিংশুক নিজে থেকে তো ফোন করেইনি।দীপ্তি ফোন করলেও হয় ধরেনি নয়তো কেটে দিয়েছে।বাধ্য হয়েই একটা মেসেজ পাঠালো “একবার ফোন করো জরুরি কথা আছে”।
রাতের পর্যন্ত ফোন আসায় এবার বেশ চিন্তাই হচ্ছে।পরপর রিং করে যাচ্ছে দীপ্তি।বেশ কয়েকবারের পর কিংশুক রিসিভ করলো
-“কী ব্যাপার এতবার ফোন করছো কেন?”
-“তোমাকে কিছু কথা বলা জরুরি।তুমিই বা রিসিভ করছিলে না কেন?গত কয়েকদিন ফোনও করোনি!”
-“করিনি।আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না তাই।
বলো কী বলবে?”
-“এবার তোমার বাড়িতে কথা বলো কিংশুক।মা বলছিলেন বিয়েটা…”
-“মানে? কিসব পাগলের মত বকছো?সবে মাস্টার্স হলো।পিএইচডি জন্য বাইরে যাবার চেষ্টা চলছে।তারপর চাকরি বাকরি। আর তুমি এর মাঝে এসব ভাবছো?
-“ঠিক আছে।বিয়ে না হয় পরেই হবে।অন্তত তোমার বাড়িতে এবার আমাদের সম্পর্কের কথাটা জানাও।দুই বাড়ির লোকজন কথা বলে রাখুক।এনগেজমেন্ট বা রেজিস্ট্রি কিছু একটা হোক।”
-“কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান কোরোনাতো।আমার বাড়ির লোক তোমায় কিছুতেই মানবে না।আর কেন মানবে বলতে পারো?নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখোনি একবারও?এই চেহারা নিয়ে কিংশুক মুখার্জির বউ হবার স্বপ্ন দেখো কী করে?”
-“মানে!তোমার এতদিনে মনে হলো এসব?আগে দেখোনি আমার চেহারা কেমন?কালো মেয়ের সাথে প্রেম করতে অসুবিধে নেই ,বিয়ে করতেই যত অসুবিধে!নাকি অন্যকিছু?”
-“শোনো তোমার সাথে প্রেম টেম কিছুই করা যায়না।আমি তোমার সাথে এতদিন প্রেমের নাটক করেছি বুঝেছো?কেন জানো?আমায় তোমার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতেই হতো তাই।তোমার মত একটা কুৎসিত মেয়ের কাছে আমি কিছুতেই হারতে চাইনি তাই।”
-“তুমি এতদিন নোটস,সাজেশন এসবের জন্য আমার সাথে ছিলে?ছি: আমি ভাবতেও পারছি না।আমি এত বোকা চার চারটে বছর ধরে তোমার কাছে এভাবে ঠকে গেলাম!তবে আমার কাছে হার তোমায় মানতেই হবে কিংশুক।আমার নোটস ,সাজেশন তুমি পেয়েছো।আমার কোয়ালিটি নয়।ফার্স্ট আমিই হবো।একটা কালো মেয়ের কাছে হারের যন্ত্রণা তোমায় মেনে নিতেই হবে।গুড বাই!”
সেদিন বাইরে যতটা শক্তি দেখিয়েছিল দীপ্তি ভেতরে ভেতরে ঠিক ততটাই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল কষ্টে।শুধু প্রেম ভেঙে যাওয়ার কষ্ট নয়।আরে প্রেম তো কোনোদিন ছিলই না।বিশ্বাস ভাঙার চেয়েও অপমান ওকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল।সেদিন মনে হয়েছিল নিজেকে শেষ করে দেয়।যদি মা ওকে জীবনের লক্ষ্যবিন্দুটা দেখাতে না পারতেন সেদিন তাহলে হয়তো আরও অনেক কালো মেয়ের মতো দীপ্তিও লজ্জায় বিষ খেতো বা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে যেত।জীবনের ওই কঠিন সময়টা একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল।ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড হয়েছিল সে।তারপর বিদেশ,ডিগ্রি ওর এই নামজশ সবকিছু সম্ভব হয়েছে ওর আত্মবিশ্বাসের জন্য।যে আত্মবিশ্বাস মানুষের চেহারায় নয় তার ইনার ফিলিংসে থাকে।
৩)
মিস সেনের চোখদুটোয় যেন আগুন জ্বলছে।অথচ মুখে সেই শান্ত হাসিটি লেগেই আছে।একটুখানি চুপ থাকলেন তারপর পামেলার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
-“এই গল্প শোনার পর তোমার মনে হচ্ছে না পামেলা তোমার এই লম্বা না হওয়াটাকে তুমি তোমার নাচ দিয়ে ওভারকাম করতে পারবে?যেদিন তুমি সেলেব্রিটি ডান্সার হবে সেদিন তোমাকে মডেল হিসেবে পাবার জন্য বড় বড় মিডিয়া হাউসগুলো তোমার বাড়ির সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।তোমার বাবা সেদিন তোমাকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতে প্রাউড ফিল করবেন।”
-“আমি তো আপনার মত এত স্ট্রং নই।আমি পারবো এই যুদ্ধটা জিততে?”
-“ইউ ক্যান ড্যু অল দিস ডিয়ার লেডি।জাস্ট বিলিভ ইন ইয়োর পাওয়ার।কে কী বললো না বললো সব ইগনোর করতে শেখো।গিভ মি আ মিনিট,আমি তোমায় একজনকে দেখাবো।যাকে দেখলে বুঝবে হোয়াট ইজ সেল্ফ মোটিভেশন।”
টেবিলে রাখা বেলটা প্রেস করে কাউকে ডাকলেন।
‘মে আই কাম ইন”? বলে ভেতরে এলেন রিসেপশনের সেই মহিলা।ইশারায় ওকে বসতে বলে পামেলার দিকে ঘুরে বললেন
-“ভালো করে ওর দিকে তাকিয়ে দেখো ওর দিকে।কী মনে হচ্ছে দেখে?”
পামেলা যখন বাইরে ওয়েট করছিল খেয়াল করেনি এই মহিলার চেস্ট তো একদম ফ্ল্যাট।ফরম্যাল শার্ট প্যান্ট পরে আছেন।মুখটা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয় ছেলে নাকি মেয়ে।
যখন সমবয়সী মেয়েদের ক্লিভেজ দেখে ক্লাসের ছেলেরা ফ্যান্টাসি করতো তখন শর্মিলার ব্রেস্ট সাইজ এতটাই ছোট ছিল যে সবাই ওকে হিজড়া বলতো ,বুলি করতো।লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে ও এক্সট্রা প্যাডেড ব্রা পরে কলেজে যেত। মিথ্যে সেই বুকের সাইজ দেখে একজন বয়ফ্রেন্ডও জুটে যায় একদিন।কিন্তু আদরের অজুহাতে বুকে হাত বোলাতে গিয়েই সে বুঝে যায় ওর বুক শূন্য।প্রেম উবে যায়।এক বান্ধবীর পরামর্শে আর বিজ্ঞাপনের হাতছানিতে কনভিন্স হয়ে শর্মিলা সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট পর্যন্ত করিয়ে আসে।একেবারে পারফেক্ট বুকের সাইজ।যেমন মডেলদের হয়।কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি।যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার কাছে কী করে যেন এই ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের খবরটা পৌঁছে যায়।সেদিন শুধু শর্মিলা নয় ওর বাড়ির লোকদেরও এত অপমানিত হতে হয়েছিল যে সেই স্ট্রেস ও নিতে পারেনি।ঘরে ঢুকে ছুরি দিয়ে নিজের ব্রেস্টদুটো কেটে দেয়।এতো ব্লিডিং হয়েছিল যে ওর বেঁচে যাওয়াটাই অসম্ভব ছিল।
দীপ্তির কাছেই ওকে রেফার করা হয়েছিল কাইন্সেলিং এর জন্য।সেই শর্মিলা সবকিছু সামলে উঠেছে।বুকের মাপ যে কোনো মেয়ের সৌন্দর্যের শেষ কথা নয় তা ও বিশ্বাস করতে এবং করাতে পেরেছে।তাই নির্দ্বিধায় প্যাডেড ব্রা ছাড়াই আজ ও রিসেপশনে বসতে পারে।ওর স্মার্টনেস অনেক পারফেক্ট সাইজের মেয়েকেও লজ্জা দেবে।
পামেলার কাছে একটু একটু করে যেন রাস্তা খুলে যাচ্ছে।একটা আলো ওকে ডাকছে।এখন মনে হচ্ছে ও সুইসাইড করতে গিয়ে কী মারাত্মক একটা ভুল করতে যাচ্ছিল।এই এখন থেকেই ও শুধু নাচ নিয়েই ভাববে।
ব্যালে ট্রুপ নিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্যুর করবে একদিন।পামেলা যেন ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে।স্টেজে পারফর্ম করছে ও আর উপচে পড়া হল এ দর্শক হাততালিতে ফেটে পড়ছে।ওই যে সামনে বসে আছে ওর স্কুল কলেজের বন্ধুরা যারা ওকে নিয়ে সবসময় খিল্লি করতো।ওই তো ওখানে বসে সেই বয়ফ্রেন্ড কাম
গ্রুমার যে ওর সাথে একটু কথা বলবে বলে অনেক ঘুরে ঘুরে এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে।জিতে যাচ্ছে পামেলা।সবাইকে হারিয়ে দিয়ে ও অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে যেখানে সবাই ওর নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।একবার ছুঁয়ে দেখতে চাইছে ওর হাত কিন্তু পারছে না কিছুতেই…