প্রবন্ধ -কমলেন্দু সরকার – G Tv { Go Fast Go Together)
প্রবন্ধ -কমলেন্দু সরকার

প্রবন্ধ -কমলেন্দু সরকার

বাংলা সিনেমার নির্বাক যুগ থেকেই হাসি বা মজার ছবি শুরু। হাসি মানেই মজা আর মজাতেই হাসি। শুধু বাংলা কেন, সারা দুনিয়ায় সিনেমার জন্মলগ্ন থেকেই হাসি বা মজার ছবি হচ্ছে। বাঙালি সিনেমাপ্রেমীরাও হেসে আসছেন শুরু থেকেই। নাকি হেসে আসছিলেন! 'হেসে আসছিলেন' এই কারণে বলা, এখন হাসি বা মজার ছবি হয়ই না! কালেভদ্রে দু'একটি হয়। এখনকার প্রযোজক, পরিচালকেরা হাসির ছবি তৈরির ঝুঁকিই নিতে চান না। -প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নামী প্রযোজক বলেছিলেন, "কাকে নিয়ে হাসির ছবি করব বলুন তো! ওই তো হাতে গোনা আছেন কয়েকজন। তাঁদের কোনও বক্স-অফিস আছে বলেও মনে তো হয় না। লগ্নিটা করব কাকে দেখে!"

বাণিজ্যিক ছবির এক হিট পরিচালক বলেছিলেন, "ধরুন, আমি 'ধন্যি মেয়ে' কিংবা 'বসন্ত বিলাপ' ছবি রিমেক করব। কাদের নিয়ে করব? কেউ নেই!" পরিচালকের নাম বলা যাবে না। আগেই শর্ত ছিল।

তবে মাঝেমধ্যে দু'একটা হাসি বা মজার ছবি হয়েছে, একেবারে হয়নি তা নয়। পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের '- ছুটি' (২০০৯), অনীক দত্তের 'ভূতের ভবিষ্যৎ' (২০১২) ইত্যাদি। ছবি চলেওছে ভাল। দর্শক ফিট, ছবি হিট।

যাই হোক, দেখা যাক বাংলা হাসি বা মজার ছবি শুরুর সময়কাল। ১৯২১, প্রথম হাসির ছবি 'দাদু বা ডাব্বুর কেলেংকারি' অরোরা ফিল্ম কোম্পানির ব্যানারে ছবিটি করেছিলেন ক্যামেরাম্যান-পরিচালক দেবী ঘোষ। ইনি ছিলেন অরোরার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।  দু'রিলের ছবি 'দাদু বা ডাব্বুর কেলেংকারি' মুক্তি পেয়েছিল 'রত্নাকর' ছবির সঙ্গে, ১৯২১, ১৩ অগস্ট, রসা থিয়েটারে পরে নাম হয় পূর্ণ। অভিনয় করেছিলেন চানি দত্ত। তবে এর আগে 'রিলের ছবি 'বিলেত ফেরত' মুক্তি পেয়েছিল একই প্রেক্ষাগৃহে ফেব্রুয়ারি, ১৯২১। কাহিনিকার-পরিচালক নীতিশচন্দ্র লাহিড়ি। অভিনয় করেন ধীরেননাথ গঙ্গোপাধ্যায় বা ডিজি, সুশীলাবালা প্রমুখ। এই ছবিটি ছিল নির্বাক যুগে সেইসময়কার সেরা রোম্যান্টিক কমেডি ছবি। টানা তিন মাস চলেছিল ছবিটি রসা থিয়েটারে। 'বিলেত ফেরত' হিট করার প্রধান কারণ ছিল ডিজি বা ধীরেননাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয়। তাঁর অভিনয় ছিল চার্লি চ্যাপলিনের আদলে। সেইসময় বাঙালি দর্শক চ্যাপলিনের ছবি দেখে অভ্যস্ত। ছবির কাহিনিতে ছিল ভরপুর মজা। নায়ক বিলেত ফেরত। কিন্তু তার আদবকেতায় সকলেই কমবেশি বিড়ম্বিত। নায়ক প্রেমে পড়ে এক যুবতীর। বিলেত ফেরত যুবকের আধুনিকতা মানতে নারাজ মেয়ের বাড়ির লোকজনেরা। সবচেয়ে মজা পেয়েছিলেন দর্শকনায়কের ভৃত্যের অভিনয়ে। 'বিলেত ফেরত' ছিল নির্ভেজাল মজার ছবি।

বিশ শতকের বিশের দশকে, নির্বাক যুগে বেশ কয়েকটি কমেডি হয়েছিল। যেমন, 'বিয়ের বাজার' 'বরের বাজার', 'কেলোর কীর্তি', 'মানিকজোড়', 'দিলদরিয়া', 'নতুন জামাই' ইত্যাদি। জামাই বা জামাইদের নিয়ে একাধিক মজার ছবি হয়েছে। অর্থাৎ  বাংলা ছবিতে জামাইরা হাসি বা মজার উপাদান হয়েছে বারবার। ইদানীং কালের পরিচালক রবি কিনাগির 'জামাই ৪২০' (২০১৫) তবে -ছবিতে নির্মল হাসির চেয়ে ভাঁড়ামি ছিল বেশি। জোর করে কাতাকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা। প্রথম বাংলা সবাক ছবিই ছিল জামাইকে নিয়ে 'জামাইষষ্ঠী' (১৯৩১) এই একই বছরে একটি নির্বাক ছবি মুক্তি পায় 'জামাইবাবু' গ্রামের জামাই গোবর্ধনের আগমন শহরের শ্বশুরবাড়ি। এখানে এসে জামাইবাবাজির নানাভাবে হেনস্তা হওয়া নিয়ে ছবি। নানারকম মজা ছিল ছবিতে। দর্শক উপভোগ করেছিলেন 'জামাইবাবু' ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালক কালীপদ দাশ। ছবির কাহিনি গোবর্ধনকে নিয়ে। এই চরিত্রে অভিনয় করেন পরিচালক নিজেই। গোবর্ধনের পরনে বাঙালি পোশাক হলেও, পরার স্টাইলে ছিল একেবারে চার্লি চ্যাপলিনের আদল, এমনকী জুতোটিও। ছবির শুরু থেকে শেষ চ্যাপলিনকে অনুকরণ করে গেছেন অভিনেতা-পরিচালক কালীপদ দাশ। মাঝেমধ্যে বাড়াবাড়ি মনে হলেও মন্দ লাগে না দেখতে। ছবিতে সেইসময়কার শহর কলকাতাকে  চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন পরিচালক। পুরনো যাত্রাপালার মিউজিক ব্যবহার করেন। ছবির সঙ্গে ভীষণভাবে যা ছিল মানানসই। মোটের ওপর উপভোগ্য ছবি 'জামাইবাবু' ছবিটি হয়েছিল হিরা ফিল্মস-এর ব্যানারে। আর 'জামাইষষ্ঠী' ছিল ম্যাডান থিয়েটার্সের প্রযোজনা। চিত্রনাট্য, পরিচালক অমর চৌধুরী।

বাঙালির ষোলো আনা নিজের পারিবারিক উৎসব জামাইষষ্ঠী। এই উৎসব কেন্দ্র করেই পরিচালক অমর চৌধুরী ছবিটি করেন। তিনি নিজেই অভিনয় করেন  হাড়কিপটে শ্বশুরের চরিত্রে। ভদ্র, শান্ত, লাজুক স্বভাবের জামাই শ্রীধর। তার শ্বশুরমশাইয়ের নাম কুবের, তিনি হাড়কিপ্টে, সুদখোর। শাশুড়ি সারাক্ষণই স্বামীর মুখঝামটা খান। শ্রীধরের স্ত্রী সরোজ। শান্ত লাজুক জামাই শ্রীধরকে জামাইষষ্ঠীর দিন শ্বশুরবাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে শরীর খারাপের অজুহাতে। সবমিলিয়ে চূড়ান্ত হাসির ছবি 'জামাইষষ্ঠী' সেইসময়কার বাংলা ইংরেজি দৈনিকে গোটা পৃষ্ঠা জুড়ে 'জামাইষষ্ঠী' বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত। বেশি দর্শক সমাগমের জন্য অগ্রিম টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন ক্রাউন হল কর্তৃপক্ষ। ছবিটি মুক্তি পায় ২৫ এপ্রিল, মতান্তরে ১১, ১৯৩১।

বিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে বাংলা সিনেমা  কথা বলতে শুরু করল, দর্শকের ভিড় বাড়তে লাগল প্রেক্ষাগৃহে। বেশিরভাগ দর্শকই হাসি বা মজার ছবি দেখতে আগ্রহী। সেইসময় বহু ছবি হত দুই, তিন, চার রিলের। তার মধ্যে হাসি-মজার ছবিই বেশি। সেইসব ছোট ছোট ছবি জুড়ে দেওয়া হত পূর্ণাঙ্গ কাহিনি চিত্রের সঙ্গে। দর্শকেরা উপভোগ করতেন। ২০ মে, ১৯৩৩। মুক্তি পেল নিউ থিয়েটার্সের 'কপালকুণ্ডলা' পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। বিভিন্ন ভূমিকায়: কপালকুণ্ডলা উমাশশী, নবকুমার দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কাপালিক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মতিবিবি নিভাননী প্রমুখ। তারকার ছড়াছড়ি ছবিতে। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল ডিজি (ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়)- 'মাসতুতো ভাই' দর্শক যতটা আগ্রহ নিয়ে 'কপালকুণ্ডলা' দেখতে গেছিলেন, ততটাই উপভোগ করেছিলেন 'মাসতুতো ভাই' জানা যায়, হাসির তুফান উঠত প্রেক্ষাগৃহে।

পরিচালক প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি 'তরুণী' সঙ্গে জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায়ের 'মণি-কাঞ্চন' (প্রথম পর্ব) মুক্তি পেয়েছিল রূপবাণীতে, সেপ্টেম্বর,১৯৩৪। ফণি বর্মার 'কৃষ্ণ সুদামা' সঙ্গে মুক্তি পেয়েছিল তাঁরই 'রিনিঝিনি-যার জের' সেকালে এমনটা প্রচলিত ছিল। সিরিয়াস কিংবা ভাল ছবি দেখার পাশাপাশি হাসি বা মজার ছবি দেখতে পছন্দ করতেন দর্শকেরা। কোনও কোনও সময় চার-পাঁচ রিলের ছোট ছবি এককভাবেও রিলিজ করতে দেখা গেছে। যেমন, 'এক্সকিউজ মি স্যর', একক রিলিজ করেছিল চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে, ৩০ মার্চ, ১৯৩৪। ছবি সুপারডুপার হিট। কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বা ডিজি। এরই মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমেডি ছবি 'রেশমি রুমাল' করলেন পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী। প্রযোজনা দিনু পিকচার্স। শ্রী-তে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল জুন মতান্তরে জানুয়ারি, ১৯৩৮। তবে প্রযোজক ঝুঁকি নিলেন না সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল জানকী ভট্টাচার্যের ছোট ছবি 'জগাপিসি' এক টিকিটেই দু'টি কমেডি ছবি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করেননি দর্শকেরা। জানা যায়, প্রেক্ষাগৃহে হাসির নাকি হুল্লোড় চলত।

চল্লিশের দশকে বিশ্বযুদ্ধ, সিনেমা তৈরির কাঁচামালের ওপর নিয়ন্ত্রণ, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে খুব-একটা অনুকূল ছিল না সামাজিক পরিস্থিতির, সংস্কৃতির জগতে। তবু্ও ছবি হয়েছে। মুক্তি পেয়েছে। দর্শক দেখেছেন ছবি। কমেডি ছবিও হয়েছে টুকটাক। তারই মধ্যে তুলসী লাহিড়ির 'ফিভার মিকচার্স' (১৯৪০), কালীপ্রসাদ ঘোষের 'জজ সাহেবের নাতনি' (১৯৪৩), অজয় ভট্টাচার্যের (গীতিকার) 'ছদ্মবেশী' (১৯৪৪), মানু সেনের 'বিরিঞ্চিবাবা' (১৯৪৪), মনুজেন্দ্র ভঞ্জের (সাংবাদিক) 'মৌচাকে ঢিল' (১৯৪৬) ছবিগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল।

পাঁচের দশকে দেখা যাচ্ছে বাংলা কমেডি ছবির প্যাটার্নটাই বদলে গেল। এই বদলের মূল কারিগর ছিলেন পরিচালক সত্যেন বসু। ছবির নাম 'বরযাত্রী' (১৯৫১) একেবারে বাঙালি ঘরানার পরিশীলিত কমেডি ছবি। এই ছবিটি সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় লিখছেন, '... সত্যেন বসুর 'বরযাত্রী' ছবি সম্প্রতি আবার দেখে টেকনিকের দিক দিয়ে অপরিণত মনে হলেও, এর ষোলো আনা বাঙালি মেজাজ এবং আশ্চর্য স্বাভাবিক রসালো সংলাপ (এখানে বসু মহাশয় কাহিনিকার বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মূল সংলাপ প্রায় অবিকৃত রেখে সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছিলেন), এর সাবলীল অভিনয় ( ছবিতে স্টার ছিল না) অজস্র হাস্যোদ্দীপক ঘটনাবলির আবেদন আজও ম্লান হয়নি। (প্রবন্ধ সংগ্রহ, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ)

'বরযাত্রী' মুক্তির পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৫২- মুক্তি পেল পরিচালক সুনীল মজুমদারের 'পাত্রী চাই' -ছবিতে ছিল কমেডিয়ানদের নক্ষত্র সমাবেশ। অভিনয় করেছিলেন-- তুলসী চক্রবর্তী, নবদ্বীপ হালদার, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, শ্যাম লাহা, হরিধন মুখোপাধ্যায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী। এই পঞ্চাশের দশকেই আর একটি কমেডি ছবি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলস্টোন হয়ে গেল। পরিচালক নির্মল দে' 'সাড়ে চুয়াত্তর' তৈরি হল বাংলা ছবির সেরা জুটি উত্তম-সুচিত্রা। বাঙালি আজও ভুলতে পারেননি ভানুর মুখে সেই সংলাপ-- মাসিমা মালপো খামু। ভানু শুধু সংলাপটি বলেই ক্ষান্ত হলেন না। মেসের বন্ধুদের দেখিয়ে দেখিয়ে মালপোয়া খেতে লাগলেন। পুরো দৃশ্যটিতে দর্শক হেসে লুটোপুটি খেতেন। আজও হন সবাই। ফকির কুণ্ডু লেনের 'অন্নপূর্ণা বোর্ডিং'য়ের মালিক রজনী চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকায় তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় অসাধারণ। তেমনই পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন রজনীর স্ত্রীর ভূমিকায় মলিনাদেবী।

শুধুমাত্র কমেডি ছবি নয়, প্রেম কিংবা পারিবারিক ছবিতেও কমেডিয়ানরা চমৎকার মজার অবসর তৈরি করতেন। সেই কারণে বাংলা ছবি প্রচুর দর্শকও পেত। বিশেষ করে, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে উত্তম-সুচিত্রার সেরা ছবিগুলো জমতোই না যদি-না মজার অবসরগুলো তুলসী, ভানু, জহর, নবদ্বীপ, শ্যাম লাহা প্রমুখ শিল্পীরা তৈরি করতেন। ছবিতে ওঁদের মজার জায়গাগুলো তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। ওঁদের তৈরি দৃশ্যগুলো দর্শকদের ছবি দেখার একঘেয়েমি কাটিয়ে তুলত। কখনও সেইসব দৃশ্য অনাবশ্যক বলে মনে হয়নি ছবিতে। বরং কমেডিয়ানরা নায়ক-নায়িকাদের সরিয়ে পর্দার দখল নিতেন অবলীলায়! এর জন্য পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং অভিনেতাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াও ছিল দুর্দান্ত।

সেইসময় বাংলা কমেডি ছবির ছিল রকমফের। 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' (১৯৫৮), 'স্বর্গ-মর্ত্ত্য' (১৯৫৮), মৃতের মর্তে আগমন' (১৯৫৯)-এর মতো ডার্ক কমেডিও হয়েছিল। তিনটি ছবিতেই প্রধান ভূমিকায় ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মধ্যে দু'টি ছবিতে ভানুর নায়িকা বাসবী নন্দী। সেকালে বাংলা ছবির পরিচালকেরা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছবির নায়ক করা  বা প্রধান ভূমিকায় রাখার স্পর্ধা রাখতেন। প্রযোজকেরাও অর্থ ঢালতে কার্পণ্য করতেন না। ভানুও তাঁর মান বজায় রাখতেন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বহু কমেডি ছবিতেই তিনিই ছিলেন নায়ক। এবং প্রতিটি ছবিই ছিল হিট। এই তালিকায় ছিল: 'পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট' (১৯৫৯), 'মিস প্রিয়ংবদা' (১৯৬৭), '৮০-তে আসিও না' (১৯৬৭), তিনটি ছবিরই নায়িকা রুমা গুহঠাকুরতা। তিনটি ছবিই ছিল হাসির ফোয়ারা।

বাংলা ছবিতে ভানু-জহর ছিল একেবারে উত্তম-সুচিত্রার মতো জনপ্রিয় জুটি। এসব আর এখন নতুন কথা নয়। ওঁদের নামেও ছবি হয়েছে একাধিক। 'ভানু পেল লটারি' (১৯৫৮), 'ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট' (১৯৭১) ছবিতে ভানুর পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের জায়গায় রায় এবং জহরের রায়ের জায়গায় বন্দ্যোপাধ্যায় হয়। চমৎকার নির্মল হাসির ছবি। এর আগে আর এক জুটি নবদ্বীপ হালদার-শ্যাম লাহাও ছিল খুবই জনপ্রিয়। ওদের প্রধান ভূমিকায় রেখে ছবি হয় 'মানিকজোড়' (১৯৫২) ছবির বিজ্ঞাপন করা হত-- হাসির হুল্লোড় মানিকজোড়। ছবিটি কমেডি ছবি হিসেবে ততটা না-উতরোলেও দুই অভিনেতা নবদ্বীপ হালদার-শ্যাম লাহার জন্য বক্স-অফিস সফল। তেমনটাই জানা যায় তৎকালীন পত্রপত্রিকার আলোচনা-সমালোচনায়।

তবে পঞ্চাশের দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কমেডি ছবির ধারণাটিই বদলে দিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের 'পরশ পাথর' (১৯৫৮) 'পরশ পাথর' কৌতুক-রস সিঞ্চিত এক উজ্জ্বল কমেডি ছবি। 'পরশ পাথর' এক কাল্পনিক পাথর। যার স্পর্শে লোহা হয় সোনা। তেমন একটি পাথর হাতে এলে সাধারণ কেরানির জীবনে কী ঘটতে পারে, তারই কৌতুক ছবির মূল বিষয়। 'পরশ পাথর' একটি সম্পূর্ণ কমেডি ছবি। ছবির মুল চরিত্র তুলসী চক্রবর্তীর অসামান্য অভিনয় সবাইকে মুগ্ধ করে, আজও করে চলেছে।

 

'পরশ পাথর'-এর সাত বছর পর সত্যজিৎ রায় পরশুরামের 'বিরিঞ্চিবাবা' গল্পটি নিয়ে বানালেন 'মহাপুরুষ' (১৯৬৫) পরশুরামের গল্প বলার একটা নিজস্ব স্টাইল ছিল। সিরিও কমিক স্টাইল। কৌতুক প্রধান গল্প। পরিচালক সত্যজিৎ রায় লেখক পরশুরামের স্টাইলটিকেই বজায় রেখেছেন ছবিতে। কৌতুক এবং ব্যঙ্গের চমৎকার এক মিশ্রণ রয়েছে 'মহাপুরুষ' (১৯৬৫)-এ। লেখা এবং ছবি দু'টিতেই। ছবিতে কৌতুকরসের অপূর্ব পরিবেশন।

ষাটের দশকের প্রায় শুরু থেকেই বাংলায় কমেডি ছবির আধিপত্য ছিল। শুরু সম্ভবত 'ভ্রান্তিবিলাস' (১৯৬৩) ছবি থেকেই। উত্তমকুমার এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বৈত ভূমিকা। যে-উত্তমকুমার রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে বাংলা ছবিতে প্রতিষ্ঠিত তাঁকে দেখা গেল একেবারে অন্যরকম চরিত্রে। বাংলা ছবিতে নায়ক নস্যি নেন সম্ভবত প্রথম দেখা গেল 'ভ্রান্তিবিলাস'-এ। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় দু'টি ভূমিকায় দু'ধরনের কমেডি করেছিলেন। অথচ দু'টি ভূমিকায় একই, বাড়ির কাজের লোক। উত্তমকুমারের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে অভিনয় করেছিলেন ভানু। চমৎকার কমেডি ছবি 'ভ্রান্তিবিলাস' বাংলা কমেডি ছবির ক্ষেত্রে তপন সিংহের 'গল্প হলেও সত্যি' (১৯৬৬) এক নতুনতর সংযোজন। -ধরনের ছবি আগে হয়েছে কি? সম্ভবত নয়। সমস্ত বয়সের দর্শকই সমানভাবে উপভোগ করেছিলেন 'গল্প হলেও সত্যি', আজও করেন আগের মতোই। এর ঠিক দু'বছর পরই 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' (১৯৬৮) রূপকথার মোড়কে যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য। আট থেকে আশি প্রত্যেকেই কমেডির রস আস্বাদন করেছিলেন, আজও করেন সমানভাবে।

ষাটের দশকে একটি গোটা ছবি হয়েছিল পেটে খিল ধরানো হাসির সমস্তরকম মালমশলা নিয়ে। ছবিটি '৮০তে আসিও না' (১৯৬৭) ছবির কাহিনি থেকে শুরু করে সংলাপ, অভিনেতা-অভিনেত্রী-- সবকিছুই ছিল হাসির বিস্ফোরণের জন্য মজুদ। বারবার দেখলেও পুরনো হয় না, প্রতিবারই নতুন লাগে আর না-হেসে উপায় নেই। গোটা ছবিটিই কমেডিতে মোড়া অথচ ছ্যাবলামি বস্তুটিই অনুপস্থিত। নির্ভেজাল, নির্মল কমেডি ছবি।

সত্তর দশকে কমেডি ছবির ধরন আবার পাল্টালো। ছবির নায়কই কমেডি চরিত্রে। উত্তমকুমার কমেডি অভিনয়ের ধারা বা ধারণাটাই বদলে দিয়েছিলেন। উত্তমকুমারের কমেডি দেখে দর্শককুল মুগ্ধ। উত্তম-সাবিত্রীর কমেডি উপভোগ করেছিলেন দর্শকেরা। 'ধন্যি মেয়ে' (১৯৭১) এবং 'মৌচাক' (১৯৭৫) ছবি দু'টি তার উদাহরণ। 'মন্ত্রমুগ্ধ' (১৯৭৭) ছবিতে সৌমিত্র-সাবিত্রী জুটি চমৎকার কমেডি করেছিলেন। এসব ছবি ছাড়াও উত্তমকুমার সত্তরের দশকে কমেডি করেছিলেন 'ছদ্মবেশী' (১৯৭১), 'আনন্দমেলা' (১৯৭৬), 'অসাধারণ' (১৯৭৭), 'ব্রজবুলি' (১৯৭৯) ইত্যাদি ছবিতেও।

উত্তমকুমারের কমেডি অভিনয়ে সংলাপ বলার ধরন, টাইমিং ইত্যাদি সবই অসাধারণ! আজ পর্যন্ত বাংলা সিনেমায় যত গুণী কমেডিয়ান কাজ করেছেন তার মধ্যে উত্তমকুমার নিঃসন্দেহে অন্যতম একজন।

উত্তমকুমার সম্পর্কে রবি ঘোষ বলেছিলেন, "... আমি তো মূলত অভিনেতা। সুতরাং উত্তমদা সম্পর্কে যা বলব, তা অ্যাকটরস্ পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে। প্রথম কথা, হি ওয়াজ পারফেক্ট ডিরেক্টরস অ্যাকটর। পরিচালক যা চাইবেন, উনি পারফেক্টলি সেটা ডেলিভার করে দিতে পারতেন। সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ-- মানিকদার নায়ক। এছাড়া অ্যাভারেজ ডিরেক্টরদের উনি অভিনয়ের চার-পাঁচটি ভেরিয়েশন দেখিয়ে অপশন চাইতেন-- কোনটা ফাইনালি ডেলিভার করবেন। অসাধারণ সেন্স অফ টাইমিং ছিল উত্তমদার। যেটা যে কোনও অভিনেতার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। মারাত্নক পজ অ্যাক্টিং জানতেন। তার সঙ্গে ক্যামেরার লেন্সে শটের ফ্রেমিং অনুযায়ী ফিজিকাল মুভমেন্টসকে কন্ট্রোল করা, বাড়ানো-কমানো। আমার মনে হয় উত্তমকুমারের ওই অসাধারণ রূপ, অনেক সময় ওর আসল গুণ যেটা, অভিনয়ের ক্ষমতা, সেটাকে ঢেকে দেয়। উত্তমদা যদি আরেকটু কম গুড লুকিং হতেন, তাহলে ওর কমেডি অ্যাক্টিংয়ের বা সব মিলিয়ে অভিনয় ক্ষমতার ব্রিলিয়ান্সটা সাধারণ দর্শকের চোখে আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ত।" (সাক্ষাৎ-স্মৃতি, কান্তিরঞ্জন দে, সিমিকা)

সত্তরেই আরও একটি অসাধারণ কমেডি ছবি হয়েছিল 'বসন্ত বিলাপ' (১৯৭৩) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন ছবির নায়ক-নায়িকা। নায়কের বন্ধু রবি ঘোষ, অনুপকুমার, চিন্ময় রায়। বাংলা ছবির সেরা অভিনেতা-কমেডিয়ান। আছেন তরুণকুমার, হরিধন মুখোপাধ্যায়ের মতো জাঁদরেল অভিনেতা-কমেডিয়ানও। তরুণকুমারের ডিসপেনসারিতে বসে যখন হরিধন 'বসন্ত বিলাপ' হস্টেলের মেয়েদের সমালোচনায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই অপর্ণা সেন এলেন ওষুধ নিতে। পা মুচকে যাওয়ার ওষুধ। অপর্ণার পা দেখবেন বলে ঝাঁপিয়ে পড়েন হরিধন। অপর্ণা বলেন, 'আমার নয়, কাজের লোকের।' বেলুনের হাওয়া বেরিয়ে গেলে যেমন অবস্থা হয়, ঠিক তেমনই হাল হল হরিধনের৷ পলকের মুহূর্ত কিন্তু অসাধারণ একটা মজার পরিবেশ তৈরি করলেন হরিধন। দৃশ্যটি হয়তো মিনিট খানেকের, দর্শক হাসলেন দশ মিনিট!

তখনকার কমেডিয়ানরা কত সুন্দর সব মুহূর্ত তৈরি করতেন। 'মাসিমা মালপোয়া খামু' শুধু সংলাপ বলা নয়, মেসবন্ধুদের দেখিয়ে দেখিয়ে ভানুর মালপোয়া খাওয়াটি যেন মনে হচ্ছে যুদ্ধে জয় করলেন। এককথায় অনবদ্য। ঠিক তেমনই 'বসন্ত বিলাপ' (১৯৭৮)- পুকুরপাড়ে বসে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়কে বলছেন চিন্ময় রায়, 'শোনো, তুমি আমাকে একবার বলো উত্তমকুমারবলো না!' চিন্ময় রায়ের এই সংলাপ হয়ে গেল চিরস্মরণীয়। দর্শক শুধু সংলাপে মজা পাননি, তাঁরা উত্তমকুমার আর চিন্ময় রায়ের চেহারাটাও মিলিয়েছেন ওই দৃশ্যে। যে-কারণে আরও ভাল লেগেছে দর্শকের। ভানু বন্দ্যোপাধায়, রবি ঘোষ, জহর রায়ের যোগ্য উত্তরসূরি চিন্ময় রায়। অমন রোগা-প্যাটকা চেহারায় কোনওরকম আকর্ষণ নেই বটে কিন্তু অ্যাটিটিউড ছিল অসাধারণ। উত্তমকুমারের কমেডি নিয়ে রবি ঘোষের ধারণা ছিল, উত্তমকুমার আর একটু কম রূপবান হলে তাঁর কমেডির ব্রিলিয়ান্স আরও বেশি চোখে পড়ত সাধারণ দর্শকদের কাছে। ঠিক এর উল্টো ভাবলে চিন্ময় রায়ের চেহারাটির জন্য  হয়তো তাঁর কমেডি আমাদের আরও বেশি ভাল লাগত। হয়তো সেইজন্যই 'চারমূর্তি' (১৯৭৮) ছবির তৈরির সময় টেনিদার ভূমিকায় চিন্ময় রায়কে নেওয়ার কথা একবারের বেশি দু'বার ভাবেননি পরিচালক। 'ননীগোপালের বিয়ে' ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এই দশকেই অত্যন্ত উপভোগ্য কমেডি ছবি করেছিলেন পরিচালক সলিল সেন 'ছুটির ফাঁদে' (১৯৭৫) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন এবং উৎপল দত্ত এই ত্রয়ী অসাধারণ কমেডি করেছিলেন সঙ্গে অবশ্যই রবি ঘোষ, জহর রায়, চিন্ময় রায়, তরুণকুমারের উপযুক্ত সঙ্গতও ছিল। 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' (১৯৭৩) ছবিতেও উৎপল দত্তের কমেডি অভিনয় দুর্দান্ত। উৎপল দত্ত সমস্ত রকম ভূমিকায় ছিলেন সাবলীল। কি বাংলা, কি হিন্দি সব ভাষার ছবিতেই তাঁর কমেডির একটা জায়গা ছিল। আবার 'অমানুষ' (১৯৭৫) ছবিতে ভিলেন এবং কমেডি অভিনয়ের মিশেলে একটা নতুন দিক উন্মোচিত করেছিলেন উৎপল দত্ত। পরবর্তী কালে তাঁর এই ধারায় বহু অভিনেতাকেই দেখা গেছিল অভিনয় করতে। সে বাংলা হোক বা হিন্দি ছবি।

'হানাবাড়ি' (১৯৫২) ছবিতে নবদ্বীপ হালদার এবং শ্যাম লাহা দু'জনে হাজির হানাবাড়িতে। তাঁদের কাছ থেকে কিনেছিলেন এক ব্যক্তি। সেখানে গিয়ে বহুরকম জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি তাঁরা। দু'জনকে পাঠানো হয় বাড়ির ভাঙা অংশে। মনে করা হয়, ওই অংশে ভূতেদের আড্ডা। নবদ্বীপ হালদার-শ্যাম লাহা বাড়ির ভাঙা অংশে পা-দেওয়ামাত্র শুনতে পেলেন কেউ যেন তাঁদের 'গুড মর্নিং' জানাচ্ছেন! এবার তাঁরা সম্মুখীন এক ব্যক্তির। তিনি আবার ইংরেজিতে কথা বলেন। ওঁরা দু'জনেই ভদ্রলোককে ভূত ঠাওরেছেন। ভয়ে কাঁপছেন। এইসময় শ্যাম লাহা ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে অদ্ভুত সুরে বলেন, 'ভূতে আবার ইংরেজি বলে দেখছি!' সেকালে এই সংলাপটি বেশ জনপ্রিয় হয়। ছবির এই অংশটুকু উপভোগ করেছিলেন দর্শকেরা।

সত্তরেই 'বসন্ত বিলাপ' ছাড়া পরিচালক দীনেন গুপ্ত আরও দু'টি মজার ছবি করেন। একটি, 'রাগ অনুরাগ' (১৯৭৫),  অন্যটি, 'প্রক্সি' (১৯৭৭) এই দশকেরই বাংলা ছবি 'সোনার কেল্লা' (১৯৭৪) এক অসাধারণ মজার চরিত্রের আগমন ঘটে। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে। তিনি গড়পারের লালমোহন গাঙ্গুলি। ওরফে জটায়ু। উনি রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক। তিনি ছিলেন ফেলুদা, তোপসের সঙ্গী। ফেলুদাদের সঙ্গে লালমোহনবাবু প্রথম সাক্ষাতেই দারুণ মজা। সেই আলাপ কলকাতায় নয়, ট্রেনে। ট্রেন কানপুরে দাঁড়ালে এক ভদ্রলোক কুলি সমেত প্রবেশ করেন ফেলুদাদের কামরায়। তিনি কুলিকে নির্দেশ দিতে দিতে ঢুকছেন। 'আও, আও, অ্যাই সমভালকে, জাপানি, ইম্পোর্টেট হ্যায়...' তারপর কুলিকে ভাড়া মিটিয়ে মাছি তাড়াবার মতো হাত নাড়িয়ে চলে যেতে বলছেন লালমোহনবাবু। কুলি আরও কিছু অর্থ দাবি করলে বলেন, 'যাও, কাফি হো গ্যায়া, জাদা হো গ্যায়া..'

তারপর সিটে বসে উদ্দেশহীন উদ্দেশে কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন লালমোহন গাঙ্গুলি। ফেলুদা, তোপসের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত এবং পর মুহূর্ত, অসাধারণ এক মজার দৃশ্য তৈরি করেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এমন সুন্দর এবং ভাল লাগার মুহূর্ত বাংলা ছবিতে ইতিহাস হয়ে গেছে। এমনই ভাললাগা, কৌতুকময় দৃশ্য দেখি 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' (১৯৬৯) ছবিতে বাঁশবনে গুপী-বাঘার পরিচয়পর্বটি। কৌতুকের সঙ্গে শিহরন-জাগানো একটি দৃশ্য দর্শকেরা উপভোগ করেছিলেন 'জয়বাবা ফেলুনাথ' (১৯৭৮) ছবিতে। যখন মগনলাল মেঘরাজের ডেরায় উপস্থিত হন ফেলুদা, তোপসে এবং লালমোহনবাবু।

ডেরায় প্রবেশ করা থেকে শরবত পরিবেশন পর্যন্ত মজা এবং রোমাঞ্চ দুটোই উপভোগ করেন দর্শকেরা। রোমাঞ্চের সঙ্গে মজার শুরু ফেলুদার খাওয়ার সময় মগনলালের ফোন পাওয়া থেকে, অর্জুনের 'খেল' দেখানো থেকে শুরু করে 'খেল খতম' পর্যন্ত। গোয়েন্দা এবং কমেডি দু'টিই সমান্তরালভাবে চমৎকার চলেছিল 'সোনার কেল্লা' এবং 'জয়বাবা ফেলুনাথ' দু'টি ছবিতেই। আজও দু'টি ছবিরই সমান আকর্ষণ দর্শকের কাছে।

আশির দশক থেকে বাংলা বাণিজ্যিক ছবির ঘরানায় বিশাল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বেশিরভাগ ছবিই হত দক্ষিণী ছবির টুকলি। ফর্মুলা ছবি আর কীসেইসব ছবিতে কমেডির জন্য কিছু সময় বরাদ্দ থাকত। কমেডি নয়, থাকত ভাঁড়ামো। দু'চারজন কমেডিয়ান যে ছিল না বাংলা ছবিতে তা নয়, ছিল। এখনও আছে। তাঁদের দিয়ে করানো হত কমেডির বদলে স্থূল ভাঁড়ামো। অথচ আশির দশকের শুরুতেই তপন সিংহ করেছিলেন 'বাঞ্ছারামের বাগান' কমেডির মোড়কে শ্লেষাত্মক ছবি। পরিচালক বাংলা কমেডি ছবির জন্য দরজা উন্মুক্ত করলেন আশির দশকে। না, বাংলা ছবি সে-পথে হাঁটল না। বাণিজ্যিক বাংলা ছবির একাধিক পরিচালক দক্ষিণের টুকলি ছবিতেই মন দিলেন বেশি।  তপন সিংহ নয়ের দশকেও চেষ্টা করলেন আরও একবার 'আজব গাঁয়ের আজব কথা' (১৯৯৮) না, বাংলা ছবির নয়া ধারার টুকলি ছবিকেই নিলেন বেশিরভাগ দর্শক।

একুশ শতকের দু'টি দশক কেটে গেল। বাংলা ছবির চিত্রটাই এখন ভিন্নরকম। প্রযুক্তির জাগলারি, গিমিক, চমকের প্রবণতার আধিক্যই বেশি। বাঙালিয়ানা কম। ছবির প্রচার বেশি। ছবি নয়, পরিচালকই প্রধান। কমেডিয়ানদের দরজা বন্ধ। ভাঁড়ামির প্রাধান্য। পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক, অম্বরীষ ভট্টাচার্য, রুদ্রনীল ঘোষ-এর মতো কয়েকজন অভিনেতাকে দিয়ে কমেডির চেয়ে ভাঁড়ামি করানো হচ্ছে। তার মধ্যে কমেডি ছবি একেবারে যে হয়নি তা নয়, হয়েছে। কয়েকটি ছবির নাম করা যেতে পারে 'বাই বাই ব্যাংকক' (২০১১), 'গোড়ায় গণ্ডগোল' (২০১২), 'মহাপুরুষ কাপুরষ' (২০১৩), 'হনিমুন' (২০১৮) ইত্যাদি। এসব ছবি কতটা কমেডি হয়েছিল সে তর্কসাপেক্ষ। চেষ্টা হয়েছিল কমেডি ছবি বানানোর।

তুলসী চক্রবর্তী, নবদ্বীপ হালদার, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, শ্যাম লাহা, হরিধন মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, অনুপকুমার, সন্তোষ দত্ত প্রমুখ কমেডিয়ান নেই বলে আমরা আক্ষেপ করি। আলাদা করে উৎপল দত্তের কথা বলতে হয়। সেই রবি ঘোষের কথার খেই ধরে বলতে হয়, কমেডিয়ান, খলনায়ক বলে আলাদা কিছু হয় না। সবাই অভিনেতা। যাঁকে যা অভিনয় করতে বলেন পরিচালক, তাঁরা তাই করেন।  তবুও বলতেই হয়, সত্যিই সেকালের মতো অমন কমেডিয়ান বাংলা ছবিতে আসেননি, আসবেন কিনা তা ভবিষ্যৎ বলবে।

তখনকার চিত্রনাট্যকাররা কমেডি তৈরি করে দিতেন। পরিশীলিত, রুচিশীল সংলাপ থাকত চিত্রনাট্যে। রসবোধ ছিল চিত্রনাট্যকারদের। সেই রসবোধ থেকেই লিখতেন হাসির সংলাপ। হাসির কিংবা মজার সংলাপের সাহায্য পেলেই অভিনয় করা সহজ হয়ে যেত কমেডিয়ানদের পক্ষে। তাই হত সেইসময়কার বাংলা ছবিতে। মজার সংলাপ না-পেলেই তা ভাঁড়ামোর জায়গায় চলে যায়। এখন তেমনটাই হচ্ছে বলে অনেকের অভিযোগ। অনেকের মতে বর্তমানে মজার সংলাপে দু'টি মানে থাকছে এবং তা অশ্লীল ইঙ্গিতও বহন করে।

 

বর্তমানে বাংলা ছবিতে বেশ কয়েকজন সু-অভিনেতা আছেন। তাঁদের কমেডি সেন্স অত্যন্ত ভাল। শুভাশিস মুখোপাধ্যায় যিনি 'শিল্পান্তর', 'হারবার্ট'-এর মতো ছবি করেন, তিনি অভিনয় জানেন না বললে সত্যের অপলাপ হয়। বা রুদ্রনীল ঘোষ 'চ্যাপলিন'-এর মতো ছবি করেন। আসলে এঁদের ছবিতে যর্থাথভাবে কমেডিয়ান হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি। বরং ভাঁড়  বানানো হয়েছে। কিন্তু এঁদের দিয়ে ভাল কমেডি ছবি করানো সম্ভব। ভাল কমেডি ছবি হতেও পারে। প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার যদি একজোট এগিয়ে আসেন তাহলে আবার বাংলা ছবি হাসবে, হাসবেন বাঙালি দর্শকেরা।

সিনেমা দেখে বাঙালির হাসি শুরুর একশো পেরিয়েছে। ১৯২১-এর 'দাদুর কেলেংকারি' বা 'ডাব্বুর কেলেংকারি' থেকে 'বিলেত ফেরত' ছবির কথা ধরলে। কিন্তু বাঙালি দর্শকেরা পুরো একশো বছর ধরে হাসতে আর পারল কই! মাঝ পথেই তো মজা বা হাসির ছবি হয়েছে হাইজ্যাক।

Leave a Reply

Translate »
Call Now Button