রক্ষাবন্ধন বাংলা ছোটগল্প @হীরক মুখোপাধ্যায়
স্বত্ব:লেখক
১৮ অগস্ট পড়ন্ত দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোলকাতা পুলিশ, বিধাননগর পুলিশ আর ক্রীড়াপ্রেমীদের ‘যেমন খুশি ছোটো’ খেলার মাঝে রেফারির মতো ছুটোছুটি করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। শরীর আর চলছিল না, তাই বাড়ি ফিরেই চটজলদি ধারা স্নান সেরে, বাহুমূলে পছন্দের ডিও স্প্রে করে; ড্রইং রুমে হালকা সবুজ রঙের নিভু নিভু এক বাতি জ্বালিয়ে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে চোখবুজে ভাবছিলাম সারাদিনের হুজ্জুতির কথাগুলো।
দূর থেকে ধিমি লয়ে কানে ভেসে আসছিল আমার পছন্দের গান ‘স্বপ্নে আমার মনে হল…।’
(২)
হঠাৎ যেন মনে হলো আমার এক অতি পরিচিত মাতৃসমা মহিলা তাঁর বসার ঘরের মেঝেতে একটা সুন্দর আসন পেতে তার সামনে ছোট একটা রেকাবিতে কিছু ধান, দুর্বা, চন্দন ইত্যাদি সব ধীরে ধীরে গুছিয়ে রাখছেন।
নীল পেড়ে সাদা কাপড় পরা বয়স্ক মহিলাকে ওভাবে একা হাতে কাজ করতে দেখে বেশ অবাক হচ্ছিলাম। কোলা ব্যাঙের মতো কেমন দুলকি চালে পা ঘষে ঘষে হাঁটছিলেন তিনি।
বয়স্ক মহিলা কোনো কিছু আনতে পা ঘষে ঘষে পাশের ঘর যেতেই অন্য আরেক ঘর থেকে তেল ভর্তি পেতলের প্রদীপ আর ইয়া বড়ো একখানা পিলসুজ নিয়ে বেরিয়ে এল এক অধদামড়া ছেলে। সাদা জামা প্যান্ট পরা ছেলেটা রেকাবির পাশে ওগুলো রেখেই সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাবর কবে মরেছিল ওসব ইতিহাসের তারিখের কথা না হয় নাই বললাম, আমি কবে জন্মেছি সেটাই যখন মনে থাকে না তখন পুজো অর্চনা বা উৎসবের তারিখের কথা আমার মাথায় থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাই গালে হাত দিয়ে বোকার মতো ভাবতে লাগলাম আজ আবার কী পার্বণ রে বাবা !
‘ফস্’ করে একটা আওয়াজ কানে আসতেই, ভাবনায় ছেদ পরল, নজরে এল মাতৃসমা ওই মহিলা দেশলাই জ্বেলে প্রদীপ আর ধূপ ধরাচ্ছেন।
যা খুশি করুক গে যাক, এই ভেবে সবে জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে যাব; তখনই চোখে আলো-ছায়ার আলপনা খেলে যাওয়ায় ভালো করে নজর করে দেখি, বসার ঘরের দরজার পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকছেন চুড়িদার পাঞ্জাবি পরা এক বয়োবৃদ্ধ ভদ্রলোক।
ভদ্রলোকের বেশ সুঠাম গড়ন। কিন্তু বয়সজনিত কারণে ইতিমধ্যে ওঁনার চুল দাড়ি গোঁফ সব পেকে সাদা হয়ে গিয়ে একেবারে বুড়ো বুড়ো লাগছে।
মাথার ব্রহ্মতালুতে ইতিমধ্যে টাক পড়তে শুরু করেছে, ভদ্রলোকের মুখে সুন্দর করে ছাঁটা পাকা দাড়িগোঁফ দেখে মনে হল ইনি নিশ্চয়ই রোজ নাপিত দিয়ে দাড়িগোঁফ ছাঁটেন, নাহলে এরকম হতেই পারে না।
বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল উনি যেন আমার বড্ড চেনা। কাজের সুবাদে বছর কুড়ি আগে যতবার গুজরাতে গেছি, ততবারই যেন ওঁনাকে কোথাও না কোথাও দেখেছি।
ভদ্রলোকের নাকটা টিকালো তো নয়ই বরং পুলিপিঠের মতো একটু মোটা, সারা শরীরে কীরকম যেন একটা দাম্ভিক দাম্ভিক ভাব।
বয়স্ক ভদ্রলোককে দুচোখ ভরে দেখতে দেখতেই নজরে এলো মেঝেতে পাতা সুন্দর আসনের উপর বাবু হয়ে বসে পড়লেন ওই বয়োবৃদ্ধ ভদ্রলোক।
বয়স্ক ভদ্রলোক আসনে বসতেই মাতৃসমা মহিলা শাঁখ বাজিয়ে বৃদ্ধের মুখের সামনে প্রদীপ ও ধূপ ঘোরানো শেষ করে বুড়োর হাতে উপহার সামগ্রী ধরিয়ে দিলেন।
চোখের সামনে মাতৃসমা মহিলা এত কিছু করলেও মাথায় আসছিল না আজ কীসের উৎসব!
ভাবনা চলাকালীন দেখলাম মাতৃসমা ওই মহিলা তার নীল পাড় দেওয়া আঁচল থেকে এক ফালি কাপড় হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে বয়স্ক ভদ্রলোকের হাতে বেঁধে দিয়ে তাঁর পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করলেন। সেকি মরাকান্না রে বাবা !
বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি পর্ব চলার পর দেখতে পেলাম মাতৃসমা মহিলা অশ্রুসজল নেত্রে কম্পিত হস্তে ওই বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখের সামনে একটা প্যাঁড়া তুলে ধরলেন।
ভদ্রলোকটাও প্যাঁড়াটা চোখ বন্ধ করে তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে প্রসন্ন হয়ে মাতৃসমা মহিলার দিকে অভয় মুদ্রা প্রদর্শন করলেন।
(৩)
আচমকা কানের গোড়ায় কে যেন বিকট রবে ঝগড়ুটে গলায় চেঁচিয়ে উঠল,”ঘটনার পর এত সময় কেটে গেলেও ‘সিবিআই’ এখনো সেরকম বলিষ্ঠ সূত্রের সন্ধান পায় নি।”
বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকাতেই দেখি টিভির কোনো এক চ্যানেলের বাংলা খবর দেখতে দেখতে মা বিড়বিড় করছে, “সব আই ওয়াশ, স্টেট-সেন্ট্রালের গটআপ, এই জঘন্য হৃদয়বিদারক মামলাতেও বোধহয় সুবিচার পাবেননা নির্যাতিতার অভিভাবকরা।”
(৪)
টিভির ভেতর থেকে সঞ্চালক তখনও ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে চলেছেন। সত্য, অর্ধসত্য, সম্পূর্ণ মিথ্যা আর মনগড়া কাহিনী দিয়ে একনাগাড়ে নির্লজ্জের মতো মালা গাঁথার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ওসব শুনতে শুনতে মধুকবির ছন্দে আমার মন যেন বিড়বিড় করে উঠল ‘গায়ত্রীনন্দিনী আমি, লোরেন মোর ভ্রাতা, আমি কি ডরাই সখি ভিখারী জনগণে।’