মাতৃত্ব
পাড়ায় কেউ কোনোদিন দেখেনি তাকে । হাড্ডি চেহারা । কোনো জৌলুস নেই চেহারার মধ্যে । কোথাও কোন মেদ লাগেনি বলে মনে হচ্ছে । কতদিন খেতে পায়নি তা কে জানে !
পাড়ায় চায়ের দোকানে বসে থাকতে থাকতে সজল দেখছিল এ সব । মেয়ে যে, তার চেহারায় স্পষ্ট । বোধহয় খুঁজছিল কোনো রুটির টুকরো একটু খাবারের আশায় । সজলের ভাল লাগলো না । সে পয়সা দিয়ে দুটো বিস্কুট কিনলো । তারপর তার মুখের গোড়ায় গিয়ে বললো, "আঃ আঃ, তু তু ।" সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা তার ল্যাজ প্রবল ভাবে নেড়ে সজলকে তার কৃতজ্ঞতা জানান দিতে লাগলো । সজলের মনটা একটু ভিজলো বটে, কিন্তু একটা অস্বস্তি তার মনকে নাড়া দিতে লাগলো । কারণ কুকুরটা তার ভালোবাসার দানকে প্রত্যাখ্যান করেছে । কুকুরেরা এই রকমই হয় বোধহয় । কুকুরটা না খেতে সজলের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল । সে নিশ্চুপ ভাবে বসে রইল ওই বিস্কুট দুটোর দিকে তাকিয়ে ।
হঠাৎ দেখে কুকুরটা বিস্কুট দুটো মুখে করে ছুটতে আরম্ভ করেছে সামনের দিকে । সজল এবার সম্বিৎ ফিরে পেল । কুকুরটা ছুটছে আর পিছনে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে সজলের দিকে । ব্যাপারটা সজলের খুব কৌতূহল জাগানোর মতো লাগলো ।
সে তাড়াতাড়ি পয়সা মিটিয়ে ছুটতে লাগলো কুকুরটার পিছনে পিছনে । কুকুরটার ওই ছোটা দেখে পাড়ার মোড়ে দাঁড়ানো আরও কয়েকটা ছেলেও ছুট লাগালো যে দিকে কুকুরটা গেছে সেই দিকে ।
কুকুরটা মাঝে মাঝে যায় আর পিছন ফিরে যেন ইশারা করে তাদের যাওয়ার জন্যে । এইভাবে বড় রাস্তা দিয়ে অল্প কিছুটা ছোটার পর এবার বাঁ দিকে নেমে ঢালু কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটতে লাগলো । মুখেতে বিস্কুট দুটো ধরা । সজল এবং পাড়ার ছেলেগুলোও ওর পিছনে । হঠাৎ কুকুরটা একবার ওদের দিকে তাকিয়ে এবারে ঢুকে গেল অপেক্ষাকৃত এক সরু গলিতে । সেখানে কিছু কিছু বাড়ি হয়েছে । বাকীটা সবই হালকা জঙ্গল । সার দেওয়া সব বাড়ি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত শেষ বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো কুকুরটা । সজলরাও ততক্ষনে সেখানে হাজির । কুকুরটা তখনও ল্যাজ দোলাচ্ছে । এক লাফ দিয়ে এক পাঁচিলের ওপর উঠেই আবার ও প্রান্তে নামলো কুকুরটা । সজলরা একটু এগোতেই দেখে যে সেখানে ভাঙা একটা বিরাট জলের ট্যাঙ্ক । সেই দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখে কতগুলো সুন্দর সুন্দর কুকুরবাচ্চা বেরিয়ে এল তার ভিতর থেকে । মায়ের আগমনবার্তা পৌঁছে গেছে তাদের কাছে । সজলরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তাদের দিকে । কালো-সাদা দুটো, একটা লালচে ধরনের আর একটা একদম সাদা । তাদের মা মুখের বিস্কুটদুটো তাদের সামনে ফেলে রেখে পরম মমতায় তাকিয়ে আছে তাদের দিকে । আর বাচ্চারা মায়ের দুধ খেতে ব্যস্ত । সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য !
সজল ছেলেগুলোকে বললো তোরা এখানে থাক । আমি আসছি । বলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল সে । তার কিছুক্ষণ পরেই সে ফিরে আসলো এক হাতে ভাত-ডাল-মাছ নিয়ে আর অন্য হাতে বিস্কুটের একটা ঠোঙা নিয়ে । সজল গিয়ে মা কুকুরটাকে একটু দূরে ডাকলো, তার সামনে মেলে ধরলো ভাত, মাছ এই সব । কুকুরটা ল্যাজ নেড়ে যেতেই লাগলো আর খেতে লাগলো সেই সব খাবার । দেখে মনে হল, কতকাল সে খেতে পায়নি । দেখতে দেখতে সজলের চোখে কখন যে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে, সে জানতেও পারেনি !