প্রবন্ধ – অনিরুদ্ধ  সরকার – G Tv { Go Fast Go Together)
প্রবন্ধ – অনিরুদ্ধ  সরকার

প্রবন্ধ – অনিরুদ্ধ  সরকার

বাঙালি মননে আজও নস্টালজিক প্রায় তিনশো বছরের কুমোরটুলি 

পলাশির যুদ্ধ শেষ হয়েছে। শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণদেব কলকাতায় দূর্গাপূজা করবেন। সেসময় কুমোরটুলির কুমোরদের দেবীর বাহন সিংহ সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। তাই রাজা নবকৃষ্ণদেবের বাড়ির প্রতিমায় সিংহের বদলে ব্যবহার হল ঘোড়া। তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়  কিন্তু বদলায়নি সেই রীতি। বদলায়নি সেই কুমোরটুলিও।

 

বড়িশার সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির পুজোকে কলকাতার বুকে দুর্গাপুজোর  সূচনা ধরলে শহর কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাস বড় জোর চারশো বছরের বেশি নয়। আর কুমোরটুলির ইতিহাস বোধহয় তারই কাছাকাছিই। 

 

হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কুমোরটুলিও তার অবস্থান পাল্টেছে বারে বারে। আজকের কুমোরটুলির অবস্থান বাগবাজারের ঠিক পাশেই। মূল কুমোরটুলি বলতে বোঝায় বনমালী সরকার স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে উত্তরে কুমোরটুলি স্ট্রিট, দক্ষিণে অভয় মিত্র লেন, পশ্চিমে স্ট্র্যান্ড রোড আর পূর্বে রবীন্দ্র সরণির মধ্যবর্তী জায়গাকে। অবশ্য এর বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কুমোরটুলি।  এখন যা 'মৃৎশিল্পীদের এলাকা' বলে পরিচিত সেই জায়গাগুলি একসময় ছিল কলকাতার বিখ্যাত জমিদারদের। যার মধ্যে গোবিন্দরাম মিত্র, গোকুলচন্দ্র মিত্র, বনমালী সরকার, নন্দরাম সেনের নাম প্রথমের দিকে। পরে বাংলাদেশের জমিদার ভাগ্যকুল রায় পরিবারের লোকজনও কলকাতায় তাঁদের বসতবাড়ি গড়ে তোলেন। তাঁদের জমির কিছু অংশ এখন কুমোরটুলির অন্তর্গত। 

বাঙালি মননে আজও নস্টালজিক প্রায় তিনশো বছরের কুমোরটুলি 

কলকাতা শহরের প্রকৃত নগরায়ন আরম্ভ হয় পলাশির যুদ্ধের ঠিক পরে পরে। তখন সদ্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় প্রবেশ করেছে। কোম্পানির কুঠিতে কাজের আশায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ ধীরে ধীরে কলকাতায় ভিড় করতে শুরু করেছে। সেসময় ভাগ্যান্বেষণে নদিয়ার কৃষ্ণনগর থেকে কিছু পুতুল তৈরির কারিগর এসে বসতি গড়লেন কুমোরটুলিতে। তাঁরা শহর কলকাতার বাবুদের জন্য ঘর সাজানোর বিভিন্ন ধরনের পুতুল তৈরি আরম্ভ করলেন। জীবিকার প্রয়োজনে কুমোররা পুতুল শিল্পের জন্ম দিল। এদিকে কলকাতার কিছু জমিদার তখন নিজেদের আভিজাত্য, বংশকৌলীন্যকে জাহির করতে ও তার প্রতীক হিসেবে দুর্গার আরাধনা শুরু করলেন। ডাক পড়ল কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের। দুর্গাপুজোর মধ্যদিয়ে সাহেবদের খুশ করতে লেগে পড়লেন জমিদাররা। শুরু হল রেষারেষি।  বাবু বিলাসীতা আর প্রতিযোগিতার মাধ্যম হয়ে উঠল এই দুর্গাপুজো। দেখতে দেখতে জমিদারি বৃত্ত ছাড়িয়ে আমজনতার উৎসবে পরিণত হল দুর্গাপূজা। আর অন্যদিকে শহর কলকাতার ছোট্ট সেই কুমোরপাড়া রূপান্তরিত হল প্রতিমা নির্মাণের প্রধান কেন্দ্রে।

 

 

ইতিহাস বলছে কুমোরটুলিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল  সেই জমিদার আমল থেকেই। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। আসলে, "রাজা আসে রাজা যায় নীল জামা গায়, লাল জামা গায়......মানুষের দিন বদলায় না"। কুমোরটুলির প্রায় চারশো শিল্পী-পরিবারকে অন্যত্র সাময়িক পুনর্বাসন দিয়ে সেই জায়গায় তাঁদের পুরনো আস্তানা ভেঙে নতুন ‘জি প্লাস ফোর আদলের স্টুডিওপাড়া গড়ে তোলারও প্রস্তাব হয়েছিল একসময়, কিন্তু!! এই কিন্তুর আর শেষ হয় নি....

 

১৯৩৩ সালে শুরু হয় কুমোরটুলির নিজস্ব সার্বজনীন দুর্গোৎসব। আগে প্রতিমা ছিল একচালা। পরে ১৯৩৭ সাল নাগাদ কুমোরটুলির বারোয়ারি পুজোয় ঘটে যায় এক অগ্নিকাণ্ড। তারপরই কুমোরটুলিতে দোচালা প্রতিমার প্রচলন ঘটান শিল্পী গোপেশ্বর পাল।

বাঙালি মননে আজও নস্টালজিক প্রায় তিনশো বছরের কুমোরটুলি 

 

এদিকে ১৯৪৭ সাল নাগাদ দেশভাগ হলে, ওপার বাংলা থেকে বিখ্যাত শিল্পী রাখালচন্দ্র রুদ্রপালের সঙ্গে হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল, মোহনবাঁশি, চার ভাই পশ্চিমবঙ্গে এসে উপস্থিত হলেন। এর পাশাপাশি যোগেন্দ্র পাল, গোরাচাঁদ পালের মত শিল্পীরাও ভিড় জমাতে শুরু করলেন কুমারটুলিতে। আর এই সময় থেকেই প্রতিমা শিল্পে এক অনন্য পরিবর্তন ঘটল কুমোরটুলিতে। নতুন ধরনের, নতুন আঙ্গিকের প্রতিমা তৈরি হতে শুরু করল। 

 

তবে মৃৎশিল্পে প্রধান পরিবর্তন এনেছিলেন কৃষ্ণনগরের গোপেশ্বর পাল। তাঁর দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীকালে রাখালচন্দ্র রুদ্রপাল, মোহনবাঁশি রুদ্রপালেরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন মৃৎশিল্পের ধারাকে।  

 

আটের দশকের শেষের দিকে  অমরনাথ ঘোষের তৈরি করা শোলার প্রতিমা পাড়ি দিয়েছিল বিদেশে, আর সেই ছিল শুরু

 

তারপর এখন এখান থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার প্রতিমা বিদেশে পাড়ি দেয়। পরিসংখ্যান বলছে কম বেশি একশোর কাছাকাছি দেশে কুমোরটুলির প্রতিমা পাড়ি দেয়।

 

 

কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের দক্ষতার কথা আজ সর্বজনবিদিত। রথযাত্রার দিন গণেশ এবং লক্ষ্মীর আরাধনা করেই দূর্গাপ্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রথমে কাঠ দিয়ে মূল কাঠামোটি তৈরি করা হয়। তার ওপর বাঁশের ফ্রেম, খড় ও সুতলি দিয়ে প্রতিমার আকার দেওয়া হয়। প্রতিমা বানাতে প্রধানত দুরকম মাটি ব্যবহার করা হয় – এঁটেল মাটি ও বেলে মাটি। এঁটেল মাটি দিয়ে প্রথমে মূর্তি গড়া হয় এবং পরে বেলে মাটি দিয়ে সেই মূর্তিগুলিকে পালিশ করা হয়। গঙ্গা থেকেই প্রধানত মাটি আনা হয়, যদিও উলুবেড়িয়া থেকে আনা মাটিই বেশী পছন্দ করেন শিল্পীরা। 

 

 

এবছর করোনা আবহাওয়ের মধ্যেও শুরু হয়েছে দুর্গাপুজোর খুঁটিপুজো। করোনার কারণে আগের বছর থেকেই শিল্পীরা একটু সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। তবে শিল্পী মানেই আশাবাদী। কুমোরটুলির শিল্পীরার তার ব্যতিক্রম নন। কুমোরটুলিতেও তাই হাজারো ভয় ভীতির মাঝে সাজো সাজো রব। মহালয়ার সকালে কুমোরটুলিতে দেবীপ্রতিমার চক্ষুদানের মাধ্যমেই ঘটে দেবীপক্ষের সূচনা। যার ব্যতিক্রম এবছরও হবে না। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই কুমোরটুলি তাই আজকের ভার্চুয়াল যুগেও   বাঙালির মননে নস্টালজিক।

Leave a Reply

Translate »
Call Now Button